মানবজীবনে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সেতুর মতো। সেতু যেমন দু’দিককে খুবই কাছাকাছি আনে, তেমনি স্বামী-স্ত্রীও দু’পরিবার, দু’মানুষ, দু’স্বভাবকে যুক্ত করে একটি জীবনে রূপ দেয়, ভিন্ন আলো, ভিন্ন স্বভাব হলেও দুজনে মিলে পৃথিবীর সৌন্দর্য পূর্ণ করে। কিন্তু বিশ্বাস আর সহমর্মিতা যদি না থাকে সেখানে অবিশ্বাস দানা বাঁধে, একপর্যায়ে অবিশ্বাস থেকে বিচ্ছেদের সুর বেজে ওঠে। একটি সর্ম্পক ভাঙনের সাথে শুধু দুটো জীবন জড়িত থাকে, তা কিন্তু নয়; এর সাথে আরও বহু মানুষের জীবন জড়িয়ে থাকে। অর্থাৎ একটি বিচ্ছেদ শুধু দুটি মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে না; মায়ের স্নেহ ও মমতা, বাবার অকৃত্রিম ভালোবাসা ও দায়িত্ব, দাদা-দাদু, ফুফু ও চাচাদের বন্ধনকে পৃথক করে দেয়। বিচ্ছেদ কোন সমাধান না। কিন্তু আমাদের সমাজে বিচ্ছেদের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতিদিন দেশে গড়ে প্রায় ৪০টি পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। গ্রামের তুলনায় শহরাঞ্চলে বেশি বিচ্ছেদ সংঘটিত হচ্ছে, বিশেষ করে ঢাকায়। বিচ্ছেদের পরিসংখ্যান কেবল পরিসংখ্যান নয়-এটি আমাদের সমাজের প্রতিচ্ছবি। সমাজটা যাচ্ছে কোথায়? এমনটাই আমাদের মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু আমরা সে দিকে নজর দিচ্ছি না। এটি মোটেও একটি সুস্থ সমাজের লক্ষণ নয়! সুতরাং এখনই সাবধান হওয়া জরুরি।
বিচ্ছেদ কখনো সমাধান নয়; বরং সাময়িক স্বস্তির আড়ালে মানসিক যন্ত্রণার সূচনা। বিচ্ছেদ কোনো প্রশংসনীয় কাজ হতে পারে না। তবে বিবাহ বিচ্ছেদ অপরাধ নয়। অনিবার্য প্রয়োজনে অনুমোদিত। শুধু প্রয়োজন ছাড়া, রাগের মাথায় বা আবেগে সিদ্ধান্ত নিয়ে বিবাহ বিন্ধন ভাঙাকে ইসলামে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে সুন্দর রাখা, মধুর রাখা হচ্ছে ইসলামের শিক্ষা। ‘‘তোমাদের মধ্যে সে-ই উত্তম, যে তার স্ত্রীর প্রতি উত্তম আচরণ করে।’’ (আত-তিরমিজি, হাদীস:১১৬২) শয়তান সবচেয়ে বেশি খুশি হয় যখন সে কোনো ঈমানদারের সুখী সংসারকে ভেঙে দিতে পারে। হাদীসে এসেছে ‘‘ হালাল কাজগুলোর মধ্যে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে অপছন্দনীয় হলো তালাক’’ (আবু দাউদ, হাদীস: ২১৭৮) সুতরাং সংসার ভাঙার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একবার নয়, শতবার ভাবুন। মধ্যস্থতা, সালিশি বা পারিবারিক আলোচনার মাধ্যমে ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটাতে না পারলে প্রয়োজনবোধে ভালো মানের আলেম অথবা ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা যিনি দিতে পারেন এমন ইসলামের দায়ীদের সাথে পরামর্শ করুন। কারণ, বিচ্ছেদ শুধু বড়দের জন্য কষ্টকর নয়; শিশুর মনে প্রচন্ড দাগ কাটে। তাদের মুখের হাসি, স্বপ্ন ও স্থিতিশীলতার ওপর আঘাত হানে। তারা সারাজীবন এ ক্ষত বহন করে বেড়ায়। তাই বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার আগে বার বার শিশুদের জীবনের কথা ভাবা প্রয়োজন। যেন শিশুর সুন্দর জীবন দু’জনের সামান্য ভুলে বর্ষার বাদলে ডুবে না যায়।
বিবাহ বিচ্ছেদ একসময় ছিল বিরল ঘটনা। পরিবার সমাজ ও আত্মীয়তার বন্ধন ছিল অটুট। শত সমস্যার মাঝেও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চেষ্টা ছিল। কিন্তু এখন সময় বদলেছে- আধুনিকতার স্পর্শ, নগরজীবনের চাপ, আর্থিক অস্থিরতা ও মানসিক ক্লান্তি সংসার জীবনকে নতুন নতুন সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ফলে প্রতিনিয়ত বিচ্ছেদের সুর ক্রমশ বাড়ছে। বাড়ছে পরিবার ভাঙনের শঙ্কা। দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোর প্রকাশিত পরিসংখ্যান দেখলেই বুঝা যায় বিচ্ছেদ কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। নিকট অতীতে দৈনিক প্রথম আলো ও দৈনিক কালের কন্ঠের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধুমাত্র ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনেই ২০২৩ সালে ১২ হাজারের বেশি তালাক রেজিস্ট্রি হয়েছে। গড়ে প্রতিদিন ৩০ টির মতো দাম্পত্য সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে। একই সময় ঢাকা দক্ষিণে এ সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার। অর্থাৎ রাজধানীতেই বছরে প্রায় ২০ হাজার পরিবার ভাঙছে। বিভিন্ন গবেষণাপত্র ও মিডিয়া রিপোর্টের ভাষ্যনুসারে তালাকের সংখ্যা ও হার উভয় ক্ষেত্রেই শীর্ষস্থানীয় জেলা ঢাকা। অর্থাৎ অন্যান্য জেলার তুলনায় ঢাকায় তালাকের সংখ্যা বেশি। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে বছরে প্রায় ১৮ থেকে ১৯ হাজার তালাক আবেদন জমা পড়ে। ঢাকার বাইরে চুয়াডাঙ্গা জেলায় সবচেয়ে বেশি বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে। জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের তথ্যনুসারে ২০২৪ সালে জেলায় মোট বিয়ে হয়েছে ৮ হাজার ১০৬টি। আর বিচ্ছেদ হয়েছে ৫ হাজার ৫২১টি যা মোট বিয়ের প্রায় ৬৮ শতাংশ।
বিবাহের সময় কেউ বিচ্ছেদের কথা চিন্তা করে না। ছেলে পক্ষ তো নয়ই; মেয়ে পক্ষও বিচ্ছেদ হয়ে যাবে- তা কল্পনাও করে না। দুটো পরিবারই সুখী পরিবারের প্রত্যাশায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কিন্তু দিন কয়েক যেতে না যেতেই আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসার ভেতর চিড় ধরা শুরু করে। অথচ এমনটি আমরা কেউ প্রত্যাশা করি না। কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ছে। তার কারণ খুঁজতে গেলে অনেক কিছুই সামনে আসে। এসব কারণের কিছু ঠুনকো, আবার কিছু কারণ অমুলক নয়। মোটামুটি কয়েকটি কারণে বিচ্ছেদের হার বেড়েই চলেছে। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে পরকীয়া। অধিকাংশ নাটক, সিনেমা ও সিরিয়ালে পরকীয়াকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে ভারতীয় সিরিয়াল আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনকে বিষিয়ে তুলছে, সমাজে অশান্তি বাড়ছে। তাছাড়া সংসারে বনিবনা না হওয়া, স্বামী দীর্ঘ প্রবাস জীবন, পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের অভাব, পারিবারিক কলহ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, যৌতুক, মাদক সেবন, নগরজীবনের চাপ, যৌন অক্ষমতা, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, সন্দেহ, উদাসীনতা, পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হওয়া, বাল্যবিয়ে, ব্যক্তিত্বের সংঘাত, সমবয়সীদের মধ্যে বিয়ে, সহপাঠীদের মধ্যে বিয়ে, পারিবারিক মতামত ব্যতিত বিয়ে, সমযোগ্যতা সম্পন্ন পাত্র-পাত্রীদের মধ্যে বিয়ে, দীর্ঘদিনের সঙ্গহীনতা, সর্বোপরি বাঁধভাঙ্গা আকাশ সংস্কৃতির অবারিত কষাঘাত। এক জরিপে প্রকাশ যে, স্বামী-স্ত্রীর ভেতর একজনের প্রতি আরেকজনের অবিশ্বাস ও সন্দেহ প্রায় ৭৩%। ফলে অবিশ্বাস থেকে বিচ্ছেদের দিকে পা বাড়াচ্ছে।
একজন পুরুষ ও একজন নারীর মনোদৈহিক পূর্ণতা এবং চাহিদা দাম্পত্য জীবনের রসায়নকে পূর্ণতা দেয়। এটা অস্বীকার করা যাবে না। অধিকাংশ সমবয়সী দম্পতিদের মধ্যে এ অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ফলে এক ধরনের বঞ্চনা তাদেরকে বিচ্ছেদের পথে ঠেলে দেয়। তাছাড়া যে পরিবারে দু’জনই চাকুরীজীবি, সে পরিবারে বেশি সমস্যা দেখা দেয়। দুজনই সারাদিনের কাজ শেষ করে যখন ঘরে ফেরেন তখন দুজনই ক্লান্ত থাকেন। কেউ কাউকে সহযোগিতা করতে পারেন না। অনেক ক্ষেত্রে ইচ্ছা থাকলেও সম্ভব হয় না। তাদের ভেতর মানসিক-দুরত্ব বাড়তে থাকে। একজন আরেকজনকে ছাড় দিতে পারে না। তুচ্ছ ঘটনায় রেগে যান। কারণ দুজনই স্বাবলম্বী। সিদ্ধান্ত নিতেও দেরী হয় না। সহপাঠী বা প্রেমের বিয়ের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা হয়। বিবাহপূর্ব প্রেম; পার্কে, রেস্টুরেন্টে, সিনেমা হলে ঘোরাফেরা, ফাস্টফুড খাওয়ার সময় দুজনেই নিজেদের অত্যন্ত মোহনীয় ও আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করেন। ভালোবাসার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। দুর থেকে ভালোবাসা যত সহজ হয়, একই ছাদের নিচে ভালোবাসা তত সহজ হয় না। বিয়ের পর সে রোমাঞ্চকর সময়গুলো বাস্তবতার কষাঘাতে হারিয়ে যায়। বিয়ে টিকে থাকার ক্ষেত্রে সামাজিক ও আর্থিক সমতা সবচেয়ে বড় বিষয়। প্রেমের বিয়ের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই এর ব্যত্যয় ঘটে। ফলে বিয়ের পর সন্দেহ এবং অবিশ্বাস মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। প্রশ্ন ওঠে প্রবঞ্চনার। বিচ্ছেদের আরেকটি বড় কারণ হলো মানিয়ে চলার অভাব। দাম্পত্য জীবনের প্রধান শর্তগুলোর একটি হচ্ছে মানিয়ে নেওয়ার মানসিকতা। যে সংসারে যত বেশি মানিয়ে নেয়ার প্রবণতা বিরাজ করে সে সংসারে তত বেশি সুখের ফ্লাগুধারা বইতে শুরু করে।
একটি পরিবারে বিচ্ছেদ হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সাধিত হয় আমাদের জীবনবোধ। শান্তির নীড় হিসেবে পরিচিত পরিবার থেকে সুখ-শান্তি উধাও হয়ে যায়। হাজার বছর ধরে পরিবার আমাদের বেড়ে ওঠার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। অথচ আজ সে পরিবার ব্যবস্থা এবং পারিবারিক মূল্যবোধ বিলুপ্তির পথে। এভাবে যদি বিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি পেতে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে আজীবন সংসার করে যাওয়া দম্পতির দেখা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, গ্রামীণ জনপদেও বিবাহবিচ্ছেদ মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে। বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে বিয়ের এক মাস না যেতেই সংসার ভেঙে যাওয়ার ঘটনা যেমন আছে, তেমনি ৫০ বছর বা তারও বেশি সময় একসঙ্গে থাকার পর দাম্পত্য সংসার ভাঙার ঘটনাও কম নয়। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, শহর-গ্রাম সর্বত্রই বিচ্ছেদ আজ একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। সুতরাং সামাজিক মূল্যবোধ ধ্বংসকারী এ প্রবণতাকে এখনই ঠেকানো জরুরি; তা না হলে পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্বই সংকটে পড়বে। ছোটখাটো ভুল বোঝাবুঝিতে বিচ্ছেদের পথে না হেঁটে সম্পর্ক রক্ষার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারলে বিবাহবিচ্ছেদের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক।