চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর বিভক্তি এখন দৃশ্যমান, যা অপ্রত্যাশিত ও বেদনাদায়ক। এর ফলে নানা ইস্যুতে নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দলগুলো এখন পরস্পর মুখোমুখি অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচন, রাখাইনে মানবিক করিডর, চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবস্থাপনা বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া, উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকজনের পদত্যাগের দাবি নিয়ে বিএনপি ও এনসিপির পালটাপালটি বক্তব্য পরিস্থিতিকে জটিল এক সমীকরণের পথে নিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে গণ-অভ্যুত্থানবিরোধী শক্তিগুলো এই বিভক্তির সুযোগ নিচ্ছে এবং বিরোধপূর্ণ পরিস্থিতিকে নানাভাবে আরও উসকে দেবে। এ রকম পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে নিকট ভবিষ্যতে দেশ ভয়াবহ অরাজকতার দিকে চলে যাবে। সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে যুগান্তরকে এমনটি জানিয়েছেন কয়েকজন বিশ্লেষক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিভক্তি ও মুখোমুখি অবস্থান গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার পরিপন্থি। তারা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর আন্দোলন করেছে, অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। সর্বশেষ ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়েছে। তাদের মূল চেতনা ও স্বপ্ন ছিল গণতন্ত্র ও একটি নির্বাচিত সরকার। ভোটে জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করবে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে দ্রুত প্রয়োজনীয় সংস্কার করবে, বাকি সংস্কার করবে নির্বাচিত সরকার। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের শক্তিগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে একে অপরকে শত্রু মনে করে নানাভাবে বিষোদগার ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। তারা বলেন, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানে যারা রক্ত দিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের কেউ ক্ষমতার ভাগ নিতে চাননি। জনগণের ভোটে ক্ষমতায় এসে দেশ পরিচালনা করেছে রাজনৈতিক নেতৃত্ব। কিন্তু এবার এর বিপরীত চিত্র দেখা গেছে। দেশের মুক্তিকামী জনতার প্রত্যাশা অনুযায়ী এক ধরনের প্রত্যাশা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলেও পরে ভিন্ন প্রেক্ষাপট সামনে আসে।
এদিকে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত বলে মনে করেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। বুধবার ঢাকা সেনানিবাসের সেনা প্রাঙ্গণে অফিসার্স অ্যাড্রেসে নির্বাচন প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সেনাপ্রধান আরও স্পষ্ট করে বলেন, তিনি ২০২৬ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচিত সরকারের হাতে দেখতে চান। ফলে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ নিয়ে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের দাবির সঙ্গে সেনাপ্রধানের বক্তব্যের মধ্যে সহমতের আভাস রয়েছে। এ বিষয়টি ইতিবাচক বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী মনে করেন, জাতীয় ঐক্য না হলে কোনো দেশ গুরুত্বপূর্ণ সংকটের সমাধান করতে পারে না। কিন্তু দুর্ভাগ্য, গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে যে ঐক্য ছিল, তা এখন নেই। দলগুলো একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি। তাদের মধ্যে একেবারেই ঐক্য ভেঙে পড়েছে। আবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেরও একটা ঢিলেঢালা ভাব, গড়িমসি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সরকার ১০ মাসে পড়েছে, অথচ সংস্কারে কোনো অগ্রগতি নেই। শুরু থেকেই সরকারের ম্যান্ডেটই ছিল দ্রুত প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে দেশকে নির্বাচনের দিকে নিয়ে যাবে। সরকার তো সেটিও করছে না। তিনি বলেন, সব কিছু মিলিয়ে মনে হয়, বাংলাদেশের রাজনীতি একটা টালমাটাল অবস্থায় চলে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির কর্মকাণ্ডে মনে হয়, জাতীয় নির্বাচনটাকে তারা বিলম্বিত করতে চায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে-নির্বাচনটা বিলম্বিত করাই তাদের মূল উদ্দেশ্যে। সুতরাং এ মুহূর্তে দেশ নিয়ে খুব একটা আশাবাদী হতে পারছি না। তবে এ সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো সবার ঐক্য। এর বাইরে সমাধান খোঁজা বোকামি। কেননা, নানা রকম দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রও এখন বড় ফ্যাক্টর হয়ে দেখা দিয়েছে। ফলে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে এসব প্রতিরোধ করতে হবে।
এদিকে আশার কথা, সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য তৈরি হয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন চায় বিএনপিসহ অন্তত ৫০টি রাজনৈতিক দল। দ্রুত সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপের দাবি জানিয়ে আসছে দলগুলো। তারা সাফ জানিয়ে দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন চায় না। তবে নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও গণপরিষদ নির্বাচনসহ আরও কয়েকটি দাবি জানিয়ে আসছে। আবার জামায়াতে ইসলামীও চায় আগে স্থানীয় নির্বাচন।
জাতীয় নির্বাচন, সংস্কার, বিচারসহ নানা ইস্যুতে রাজপথ এখন সরগরম। এর মধ্যে আদালতের রায় ও নির্বাচন কমিশনের গেজেট ঘোষণার পরও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসাবে বিএনপি নেতা প্রকৌশলী ইশরাক হোসেনকে শপথ না পড়ানোর প্রতিবাদে টানা ৯ দিন ধরে আন্দোলন করেছেন তার সমর্থকরা। শপথ না পড়ানোর পেছনে এনসিপিকে দায়ী করে এ ইস্যুতে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের পদত্যাগ দাবিও করেছেন ইশরাক হোসেন ও তার সমর্থকরা। যদিও বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত একটি রিট খারিজ করে দিয়ে আদালত শপথ পড়ানোর নির্দেশনা দেওয়ার পর ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি স্থগিত করেন ইশরাক হোসেন।
এর আগে ইসি পুনর্গঠন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে বুধবার নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে এনসিপি। সেখানে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ দাবি করেন এনসিপির মুখ্য সংগঠক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তিনি সরকারের উদ্দেশে বলেন, ‘উপদেষ্টা প্যানেলে যারা বিএনপির রয়েছে, তাদের অতি দ্রুতগতিতে বের করে দিন।’
একাত্তরসহ কয়েকটি ইস্যুতে এনসিপির সঙ্গে জামায়াতেরও দূরত্ব চলছে। যা নিয়ে সম্প্রতি দুই দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একে অপরের বিরুদ্ধে স্ট্যাটাসও দিয়েছেন। গণ-অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় দুই স্টেকহোল্ডার বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে এখন প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে অভ্যুত্থানের আরেক শক্তি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকা ছাত্রদের গড়া দল এনসিপি।
এ অবস্থায় বর্তমানে রাজনীতির মাঠের অন্যতম শক্তি বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির এ রকম বিরোধকে খুবই দুর্ভাগ্যজনক বলছেন বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, এ বিরোধের পেছনে কোনো তৃতীয় শক্তি কাজ করে থাকতে পারে। যারা দেশকে স্থিতিশীল দেখতে চায় না। তবে এভাবে চলতে থাকলে পতিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সুযোগ নেবে। যা গণ-অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। এজন্য সরকারের উচিত কোনো ষড়যন্ত্রকে সুযোগ না দিয়ে দেশকে দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের দিকে নিয়ে যাওয়া। নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে বেশি মনোযোগী হলে সবার জন্য মহাবিপদ ডেকে আনতে পারে।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ৯ মাস পার হয়েছে। কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী কিছু হচ্ছে না। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে সবকিছু অস্পষ্ট করে রাখা হয়েছে। দেশের বেশিরভাগ মানুষের মতামত উপেক্ষা করে নির্বাচন পেছানো হচ্ছে। তিনি বলেন, আকাঙ্ক্ষা থাকা দোষের না। তবে জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে নিজেদের অবস্থানকে অনেকে বিবেচনায় নিয়ে রাতারাতি অনেক কিছু হতে চাইছেন। সমস্যাটি এখানেই। তিনি বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে-১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ৯০- এর গণ-অভ্যুত্থানে যারা রক্ত দিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের কেউ ক্ষমতার ভাগ নিতে চাননি। কিন্তু এখন আমরা ভিন্ন চিত্র দেখতে পারছি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাবেক সচিব আবু আলম শহিদ খান বলেন, এখন জনগণের কাছে অনেক বার্তা যাচ্ছে। একাত্তর, নব্বই ও চব্বিশকে মিলিয়ে জনগণ যে আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের পরিণতি দেখতে চেয়েছিলেন সেখানে এখন যা দেখছেন তাতে তারা হতাশ। তাদের স্বপ্নটা ফিকে হয়ে যাচ্ছে। এটা খুব স্বাভাবিক। তাই রাজনৈতিক দলসহ সবাইকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। জাতীয় নির্বাচনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, এনসিপি আন্দোলন করছে স্থানীয় নির্বাচন আগে দিতে হবে, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে। কিন্তু এ নির্বাচন কমিশন তো এই সরকারই বানিয়েছে। এই দুটি দাবির সঙ্গেই তো অনেকে একমত হবেন না। বিশেষ করে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবির সঙ্গে বড় দল বিএনপি কখনোই একমত হবে না। কারণ বিএনপি জানে স্থানীয় নির্বাচন আগে হওয়ার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। আগের স্বৈরশাসনের সময়েও হয়েছে-নতুন রাজনৈতিক দলকে শক্তি জোগানের জন্য স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করা হয়েছে। সেখানে বিএনপি ফিরে যাবে কেন? এনসিপিকে চিন্তা করতে হবে তারা কি কি বিষয়ে একটা বড় ঐকমত্যে পৌঁছাবে। এটা এনসিপির ইস্যু। ফলে বল কিন্তু এনসিপির কোর্টে। ভোট বা সমর্থন ইস্যুতে বিএনপির কি সমর্থন আছে এবং এনসিপির কি সমর্থন আছে-তা সবাই জানে। এজন্য এই বিভক্তি কাম্য নয়।