বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে আসছেন না নাকি আসতে পারছেন না—এই প্রশ্নটি আপনার মনেও আছে। তবে এতদিন যেমনটি মনে করা হতো যে, তারেক রহমান দেশের পরিস্থিতি আরেকটু স্থিতিশীল হলেই বা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলেই দেশে চলে আসবেন, সেই ধারণায় একটা বড় ধরনের প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দিয়েছেন তারেক রহমান নিজেই। ফলে এটি এখন স্পষ্ট যে, তিনি আসলে আসতে পারছেন না। কেননা দেশে ফেরার বিষয়টি তার একক নিয়ন্ত্রণে নেই। প্রশ্ন হলো, কে বা কারা এটা নিয়ন্ত্রণ করছেন?
বাংলাদেশ সময় শনিবার সকালে লন্ডনে থেকে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দেন তারেক রহমান। সেখানে তিনি লেখেন, ‘এমন সংকটকালে মায়ের স্নেহ–স্পর্শ পাবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা যে-কোনো সন্তানের মতো আমারও রয়েছে। কিন্তু অন্য আর সবার মতো এটা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমার একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ অবারিত ও একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়।’

তারেক রহমানের দেশে ফেরার সিদ্ধান্তটি তার নিজের হাতে নেই—এরকম কথা সামনে আসার পরে অনেকে মনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে যে, তাহলে এটা কি অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর নির্ভর করছে? সরকার কি তার দেশে ফেরার ব্যবস্থা করছে না বা তার দেশে ফেরার পথে কোনো আইনি, রাজনৈতিক বা কৌশলগত সমস্যা জিইয়ে রেখেছে? ‍

সরকারের উপদেষ্টা ও অন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কথাবার্তায় অবশ্য সেটি মনে হয় না। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমও বিষয়টি পরিষ্কার করে বলেছেন যে, তারেক রহমানের দেশে ফেরার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বাধা নেই। শনিবার ফেসবুক পোস্টে প্রেস সচিব লিখেছেন, ‘এ ব্যাপারে সরকারের তরফ থেকে কোনো বিধিনিষেধ অথবা কোনো ধরনের আপত্তি নেই।’

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান ওয়ান–ইলেভেনের পর ২০০৮ সালে কারাগার থেকে বেরিয়ে সপরিবার যুক্তরাজ্যে যান। তারপর আর তিনি দেশে ফেরেননি। বিদেশে থেকেই দল পরিচালনা করে আসছেন তিনি।

গত বছর জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় বিভিন্ন মামলায় তারেক রহমানের সাজার রায় বাতিল হওয়ার পর তার ফেরার আলোচনা শুরু হয় এবং তারেক রহমান শিগগিরই দেশে ফিরবেন বলে বারবার বলা হলেও সুনির্দিষ্ট কোনো দিনক্ষণ কেউ বলতে পারেননি। কিন্তু সম্প্রতি খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে এবং তার জীবন অত্যন্ত সংকটাপন্ন বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পরে শোনা যাচ্ছিল, তারেক রহমান হয়তো খুব দ্রুতই দেশে আসবেন। কিন্তু এরকম বাস্তবতার ভেতরে তারেক রহমান ফেসবুক পোস্টে বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন যে, তার দেশে ফেরাটা খুব সহজ নয়।

অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার পতনের পরে এক বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেলও তারেক রহমান কেন দেশে আসছেন না বা আসতে পারছেন না—সেটি নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রশ্ন। কিন্তু এর সঠিক উত্তর এখনও অজানা।

তারেক রহমান দেশে ফিরলে তিনি দেশের রাজনীতির প্রাদপ্রদীপে চলে আসবেন। সুতরাং যারা চায় নির্বাচন বিলম্বিত হোক কিংবা যারা মনে করে বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশের রাজনীতি আগের মতো একই ধারায় চলতে শুরু করবে, তারেক রহমানের ফেরার পথ তৈরিতে সরকার কি তাদের গ্রিন সিগন্যালের অপেক্ষা করছে? যদি সত্যিই এরকম কোনো পক্ষ থাকে যাদের গ্রিন সিগন্যাল ছাড়া তারেক রহমানের দেশে ফেরা কঠিন—সেই পক্ষটি কি বিএনপির চেয়েও বেশি শক্তিশালী?

তারেক রহমানের আইনজীবীরা একাধিকবার বলেছেন যে, তার বিরুদ্ধে মামলাগুলো নিষ্পত্তি হয়েছে, ফলে তার দেশে ফিরতে বাধা নেই। এমনটিও মনে করা হয়, কিছু আইনি জটিলতা থাকলেও দেশে ফিরলে তারেক রহমানের গ্রেপ্তার হওয়ার শঙ্কা নেই। সুতরাং, এতকিছুর পরেও তারেক রহমানের দেশে ফিরতে না পারার পেছনে সত্যিই কী কারণ থাকতে পারে, বা কোন দেশি-বিদেশি শক্তি বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করছে, জনমনে সেই প্রশ্নটি জোরালো হচ্ছে।

তারেক রহমানের দেশে না ফেরা বা ফিরতে না পারার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ সম্ভবত তার সিকিউরিটি থ্রেট বা নিরাপত্তা ঝুঁকি। এই নিরাপত্তা ঝুঁকিটা অভ্যন্তরীণ নাকি আন্তর্জাতিক, সেই প্রশ্নও আছে। তবে অনেকে মনে করেন, জীবনের নিরাপত্তা ঝুঁকি একজন রাজনীতিবিদের নিজ দেশে ফিরে আসার পথে কোনো বাধা হতে পারে না—যদি জনগণ তার সঙ্গে থাকে। এ বিষয়ে অ্যাকাডেমিক তর্ক এবং আবেগের বাইরেও ব্যক্তিভেদে কিছু কিছু বিষয়ের ব্যাখ্যা ভিন্ন হতে পারে। তারেক রহমানের নিরাপত্তা ঝুঁকির ব্যাপ্তি আসলে কতটা এবং তিনি সত্যিই দেশে এসে বিপদগ্রস্ত হলে তার ফলে দেশের রাজনীতিতে তার প্রভাব কী হবে, সেটি অনেক বড় প্রশ্ন।

কোনো বিদেশি শক্তি বা বিদেশি গোয়েন্দা বাহিনী তারেক রহমানকে হত্যার চেষ্টা করতে পারে—এমন একটি শঙ্কার কথা বাতাসে ভেসে বেড়ায়। যদি তাই হয়, তাহলে সেই শঙ্কা এখনও বিদ্যমান কি না, অর্থাৎ ৫ আগস্টের পরেও কি তারেক রহমানের জন্য সেই ঝুঁকিটা আছে কি না—এটিও বড় প্রশ্ন।

আরেকটি প্রশ্ন জনমনে আছে, সেটি হলো, দেশের অভ্যন্তরে কোনো শক্তি কি এখনও তারেক রহমানের জন্য হুমকি, যাদের কারণে তিনি দেশে আসতে ভয় পাচ্ছেন? যদি এরকম কোনো শক্তি সত্যিই থাকে, তাহলে তাদের মোকাবিলা করার মতো রাজনৈতিক শক্তি কি বিএনপির নেই? তবে সত্যিই তারেক রহমান জীবনের নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে দেশে আসছেন না নাকি এর পেছনে অন্য কোনো বিষয় আছে, সেটি এখনও পরিষ্কার নয়।

অনেকে মনে করেন, তারেক রহমান দেশে ফিরলে তিনি দেশের রাজনীতির প্রাদপ্রদীপে চলে আসবেন। সুতরাং যারা চায় নির্বাচন বিলম্বিত হোক কিংবা যারা মনে করে বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশের রাজনীতি আগের মতো একই ধারায় চলতে শুরু করবে, তারেক রহমানের ফেরার পথ তৈরিতে সরকার কি তাদের গ্রিন সিগন্যালের অপেক্ষা করছে? যদি সত্যিই এরকম কোনো পক্ষ থাকে যাদের গ্রিন সিগন্যাল ছাড়া তারেক রহমানের দেশে ফেরা কঠিন—সেই পক্ষটি কি বিএনপির চেয়েও বেশি শক্তিশালী?

প্রসঙ্গত, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত ৩ নভেম্বর বিএনপি প্রাথমিকভাবে ২৩৭টি আসনে যে দলীয় প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে, সেখানে বগুড়া ৬ আসনে আছে তারেক রহমানের নাম। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তারেক রহমান কি এখনও বাংলাদেশের নাগরিক বা ভোটার আছেন? এক-এগারোর সরকারের আমলে নানাবিধ নির্যাতন ও চাপের মুখে লন্ডন চলে যাওয়ার পরে তিনি কি বাংলাদেশের পাসপোর্ট স্যারেন্ডার করেছেন? লন্ডনে তিনি কোন স্ট্যাটাসে আছেন এবং এখনও তিনি বাংলাদেশের ভোটার আছেন কি না; ভোটার না হলে বগুড়া ৬ আসনের প্রার্থী হিসেবে কীভাবে তার নাম ঘোষণা করা হলো; যদি তিনি ভোটার না হয়ে থাকেন তাহলে আগামী নির্বাচনের আগে দেশে ফিরে তার পক্ষে ভোটার হওয়া সম্ভব কি না—এসব প্রশ্নও জনমনে আছে।

বিশেষ করে মাকে নিয়ে তারেক রহমানের সবশেষ পোস্টের পরে এই প্রশ্নগুলো আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়েছে। এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে আমাদের হয়তো আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু তারেক রহমানের দেশে ফেরাটি সত্যি সত্যিই কে বা কারা নিয়ন্ত্রণ করছেন—সেই সত্যটি শেষমেষ আড়ালেই থাকতে পারে।

পরিশেষে, তারেক রহমান দেশে ফিরলেই দেশের রাজনীতি বদলে যাবে বা দেশ এখন যে ধরনের সংকট ও বিশৃঙ্খলার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, সেগুলো রাতারাতি দূর হয়ে যাবে, এমনটি বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু দেশকে সঠিক পথে রাখা এবং দ্রুত মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে যাত্রা শুরু করতে যে ধরনের রাজনৈতিক চাপ তৈরি করে রাখা দরকার, তারেক রহমান দেশে ফিরলে সেটি বিএনপির পক্ষে অনেক সহজ হবে—এটি বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে।

লেখক : সাংবাদিক ও লেখক।

এইচআর/জেআইএম



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews