পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান বাংলাদেশের—এই তিনটি জেলার অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার থেকে সম্পূর্ণ সমস্যা ও সম্ভাবনা : প্রেক্ষাপট পার্বত্য চট্টগ্রাম আলাদা।

অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করতে গেলে দেখা যায়, ভৌগোলিক কারণে এখানকার জীবন ও জীবিকা সমতলের চেয়ে কঠিন ও কষ্টসাধ্য।



১৯৯৭ সাল তথা শান্তিচুক্তির পরে পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করে। কাঠামোগত সংস্কার; যেমন—রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠার ফলে মানুষ অধিকতর শিক্ষার সুযোগ পেয়েছে।

পর্যটন সম্ভাবনা

কৃষির পাশাপাশি এ অঞ্চলে পর্যটনশিল্পের অভূতপূর্ব সম্ভাবনা রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে পর্যটনের ব্যবসা বেশ সরব ছিল; যদিও বা পর্যটনশিল্পের সঙ্গে এলাকার সাধারণ আদিবাসীদের সংযুক্তি খুব বেশি একটা চোখে পড়ার মতো নয়।

পর্যটনশিল্প নিয়ে কোনো ধরনের সামগ্রিক পরিকল্পনা না থাকার কারণে যাদের হাতে টাকা ও ক্ষমতা রয়েছে তারাই মূলত এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত থেকে লাভবান হতে পেরেছে। পর্যটনশিল্প ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অভাবের কারণে এই শিল্পের উন্নয়ন এবং উপকারের সমবণ্টন হচ্ছে না। এক জরিপে দেখা যায়, বান্দরবানে পর্যটন মৌসুমে প্রতিদিন তিন থেকে পাঁচ কোটি টাকার আর্থিক লেনদেন হয় শুধু পর্যটকের হাত ধরে। কিন্তু সম্প্রতি রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিভিন্ন সময়ে পর্যটকের ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে দেখা যায়।

নিষেধাজ্ঞার সময় যত প্রলম্বিত হবে, এর ক্ষতির পরিমাণও তত দীর্ঘ হবে। বান্দরবান সদরের কিছু অঞ্চল নীলগিরি, নীলাচল ও মেঘলা স্পটগুলো খোলা থাকার কারণে সদরের ব্যবসা ভালো থাকলেও অন্যান্য উপজেলার সাধারণ ব্যবসায়ীরা বন্ধ থাকার কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। উল্লেখ্য, ভারতের জম্মু-কাশ্মীর অধ্যুষিত এলাকায় বিশেষ কৌশল পরিকল্পনার মাধ্যমে ট্যুরিস্ট স্পটগুলো উন্মুক্ত রেখেছে। ফলে এলাকার সাধারণ মানুষ উপকার পাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটন পরিকল্পনা ও কৌশল পরিকল্পনার ক্ষেত্রে এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।

 পরিবেশ ও ভৌগোলিক অবস্থা

সম্প্রতি পাহাড়ে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, পানিসংকটসহ উৎপন্ন পণ্য বাজারজাতকরণের অভাবে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে পাহাড়ে, বিশেষ করে বান্দরবানের কয়েকটি উপজেলায় কয়েক বছর ধরে ঝরনা শুকিয়ে যাওয়ার কারণে পানিসংকট বাড়ছে। ফলে ফসল উৎপাদন এবং সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। পাহাড়ে ঝিরি-ঝরনা শুকিয়ে যাওয়ার পেছনে যে নীরব ঘাতকরা কাজ করছে তাদের বিরুদ্ধে কখনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ঝিরি-ঝরনা ও পানির উৎসস্থলগুলোতে বন সংরক্ষণ করা না হলে এ অঞ্চলে পানিসংকট আরো তীব্র হবে। অর্থনৈতিক মুক্তি বিকল্প কর্মসংস্থান এবং সচেতনতার মাধ্যমে অংশীদারির ভিত্তিতে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ সংরক্ষণে এখানকার আদিবাসী সমাজকে সম্পৃক্ত করা অত্যন্ত জরুরি।

 রাজনীতি

এ অঞ্চলের আদিবাসীদের ভূমি অধিকার নিয়ে বহুদিন ধরে কথা বলে এলেও সাধারণ মানুষ এখনো ভূমিহীন হয়ে আছে। বিশেষ করে পাহাড়ে গ্রামাঞ্চলের মানুষগুলোর নিজস্ব কোনো ভূমি নেই বললেই চলে। এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ আগে থেকেই প্রথাগত আইনের ওপর নির্ভরশীল। প্রথাগত আইনে ভূমির মূল মালিক রাজা। এ অঞ্চলের মানুষ ভূমির ক্ষেত্রে রাজার ওপর নির্ভরশীল এবং বিশ্বাস করে। ফলে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক জটিলতা, বিশেষ করে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকে এই সমস্যা শুরু হয় এবং পরে ১৯৭১ সালের পরে আরো নতুন মাত্রায় রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও আজ পর্যন্ত চুক্তির সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়ায় এখানকার মানুষের ভূমি অধিকার অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

 সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা

পাহাড়ের মানুষগুলো এখনো পাহাড় সমান জীবন সংগ্রামের কষ্ট, বাধা-বিপত্তি, আর্থিক দৈন্য, নিজস্ব সংস্কৃতিচর্চার অভাবসহ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগছে। পাহাড়ে অপরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন ঘটে চলেছে। আদিবাসীদের শিক্ষাদীক্ষা ও সচেতনতার অভাবে জাতীয় পর্যায়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মকাণ্ড থেকে পিছিয়ে আছে। কিছু সম্প্রদায় শিক্ষিত হলেও এখনো অনেক আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ পিছিয়ে রয়েছে। ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মবিশ্বাস সমতলের মানুষের চেয়ে আলাদা হওয়ার কারণে আদিবাসী সমাজ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা দেওয়ার প্রয়োজন আছে। এ ব্যাপারে পাঠ্যপুস্তকে সঠিক ধারণার পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধি করার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মিডিয়াকে এগিয়ে আসতে হবে।

পাহাড়ের জুমচাষ থেকে শুরু করে কৃষি ও পর্যটনশিল্প এখন ধসের মুখে। ৫ আগস্টের পর এ অঞ্চলের মানুষ রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি জাতিগত উসকানিমূলক দাঙ্গার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাহাড়ে উসকানিমূলক জাতিগত দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও সম্প্রতি মিডিয়ার নীরব এবং অনেক ক্ষেত্রে উপেক্ষামূলক ভূমিকার কারণে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ নিপীড়িত ও নিগৃহীত হয়েছে। সাধারণ মানুষ সব কিছু মিলিয়ে আশঙ্কার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। এখনো পর্যটনকেন্দ্র সবগুলো খুলে দেওয়া হয়নি।

সব কিছু মিলিয়ে পাহাড়ের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অবস্থানে ও নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা—সব কিছু মিলিয়ে এর থেকে উত্তরণের জন্য জনগণ ও সরকারের সমন্বিত প্রয়াস ও উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ঐশ্বর্যমণ্ডিত অপার সম্ভাবনার একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল। ভূমি অধিকার, জাতিগত উত্তেজনা, অনুন্নয়ন এবং পরিবেশগত অবক্ষয় সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার মাধ্যমে এ অঞ্চলের উন্নয়ন সম্ভব। কার্যকর শাসন ও আদিবাসী অধিকার সংরক্ষণের মাধ্যমে এ অঞ্চলের সম্ভাবনাকে উন্মোচিত করা সম্ভব।

এ অঞ্চলের মানুষ বিচ্ছিন্নতায় নয়, জাতীয় সম্পৃক্ততায় বিশ্বাস করে। শান্তি, স্থিতিশীলতা, উন্নত অবকাঠামো, কমিউনিটি, ইনক্লুসিভ ট্যুরিজম এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে পার্বত্য অঞ্চল বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পাবে।

বাংলাদেশ সময়: ১২১৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০২৫

এসএএইচ



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews