ছবির উৎস, Abhishek Chinnappa/Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর জয় উদযাপনের সময় পদপিষ্ট হয়ে ১১ জনের মৃত্যু হয়, আহত হয়েছেন বহু মানুষ
Author,
ইমরান কুরেশি
Role,
বেঙ্গালুরু থেকে, বিবিসি হিন্দি
২ মিনিট আগে
ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) ইতিহাসে এক মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী হলো বেঙ্গালোর।
আইপিএল ফাইনাল ম্যাচ জেতার পর রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর (আরসিবি) বিজয় উদযাপনের সময় বুধবার (চৌঠা জুন) পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যু হয় ১১ জনের। আহত হন কমপক্ষে ৩৩ জন।
এই ঘটনার বেশ কয়েকটা দিক নিয়ে প্রশাসন ও তার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। এই মুহূর্তে সেসব প্রশ্নের উত্তর মিলেছে কিছুটা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আর কিছুটা অনুমানকে কেন্দ্র করে।
আরসিবি'র ঝুলিতে আইপিএল টুর্নামেন্টের ট্রফি এসেছে ১৮ বছর পর। সেই জয়ের আনন্দ ভারতের তথ্য-প্রযুক্তির রাজধানী বলে পরিচিত এই শহরে একটা উন্মাদনার পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল।
আরসিবি-র জয়ের উদযাপন শুরু হয়েছিল মঙ্গলবার ফাইনাল ম্যাচ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। জয়ের আনন্দে মঙ্গল ও বুধবারের মধ্যবর্তী রাতে আতশবাজি ফাটানো হয়। শহরে অনেকাংশে রাত তিনটে পর্যন্ত পুলিশ বাহিনীকে দেখা গিয়েছিল।
এরপর বুধবার সকাল সাতটা বেজে এক মিনিটে আরসিবি-র আনুষ্ঠানিক এক্স হ্যান্ডেল (সাবেক টুইটার) থেকে ঘোষণা করা হয়, বেঙ্গালোরের বিধান সৌধ (বিধানসভা) থেকে চিন্নস্বামী স্টেডিয়াম পর্যন্ত ভিক্ট্রি প্যারেড বা বিজয় মিছিল হবে।
আরসিবি-র পোর্টাল থেকে এর জন্য বিনামূল্যে পাস ডাউনলোড করা যাবে বলেও ঘোষণা করা হয়েছিল। এরপর দুপুর তিনটে বেজে ১৪ মিনিটে রোড শোয়ের ঘোষণা করা হয়। জনসাধারণের উদ্দেশ্যে বার্তা দেওয়া হয়, তারা যেন পুলিশ প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সব নির্দেশাবলী মেনে চলে।
ছবির উৎস, AFP via Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
অনুমানের চাইতে কয়েকগুণ বেশি ভিড় হয়েছিল ঘটনাস্থলে
এখন পর্যন্ত এই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি যে রাত পৌনে দু'টো থেকে সকাল সাতটার মধ্যে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু কার কাছ থেকে অনুমতি (ভিক্ট্রি প্যারেডের জন্য) পেল।
কর্ণাটকের সাবেক ডিজিপি এসটি রমেশ বিবিসি হিন্দিকে বলেন, "শেষ ওভার পর্যন্ত আমরা জানতাম না কে ট্রফি জিতবে। চৌঠা জুন বেঙ্গালুরুর উদ্দেশে টিম (আরসিবি) রওনা দেয়।"
"এই পরিস্থিতিতে শহরের পুলিশের কাছে কি সব ব্যবস্থা করার জন্য পর্যাপ্ত সময় ছিল? মনে রাখতে হবে এটা কিন্তু মোটেই সহজ কাজ নয়।"
তিনি জানিয়েছেন, এই সমস্ত ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দেখতে হয় কে কোথা থেকে আসবে এবং কে কোথায় যাবে। ওই সময়ের মধ্যে কীভাবে ভিড় নিয়ন্ত্রণ করা হবে সেই বিষয়টাও নজরে রাখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
একই সঙ্গে সেই সময় যাতে কোনো অপরাধ না ঘটে তাও নিশ্চিত করতে হয়। ভিড়ের মধ্যে নারীদের সঙ্গে অশালীন আচরণের ঘটনা যাতে না হয়, সে বিষয়টাও লক্ষ্য রাখা দরকার।
আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কতটুকু নিরাপত্তা বাহিনী কতটুকু মোতায়েন করা হবে।
ওই সাবেক কর্মকর্তা বলেন, "আইনশৃঙ্খলারও তো একটা দিক আছে। পুলিশ কি সবকিছু পরিকল্পনা করার জন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছিল? এত কম সময়ের মধ্যে পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করার অর্থ আপনাকে প্রতিবেশী জেলা থেকেও পুলিশ বাহিনী আনাতে হতে পারে।"
"নগর পুলিশের হাতে কি এত কিছু করার সময় ছিল? কেউ কিন্তু এগুলোর কিছুই জানে না।"
বেঙ্গালোর সিটি পুলিশের তরফে জানানো হয়, ওইদিন বিকেল পাঁচটায় স্টেডিয়ামে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হবে। বিকেল তিনটে বেজে ২৮ মিনিটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রাফিক সংক্রান্ত বিধিনিষেধের কথা জানিয়ে একটা প্রেস নোট জারি করা হয়।
তবে রোড শো হবে না কি উন্মুক্ত বাস নিয়ে প্যারেড হবে, তা বলা হয়নি।
এই সময় পর্যন্ত, পুলিশের পক্ষ থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন কোনো বার্তা ছিল না যে আরসিবিকে বিধানসভা থেকে চিন্নাস্বামী স্টেডিয়াম পর্যন্ত ভিক্ট্রি প্যারেড করার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
ছবির উৎস, AFP via Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় স্টেডিয়ামের বাইরে
চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার দর্শক ধারণ ক্ষমতা থাকলেও পুলিশ আশা করছিল ওইদিন এক লাখের বেশি মানুষের জমায়েত হবে না।
কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তাদের সেই ধারণা ছাপিয়ে গিয়ে অনেক বেশি ভিড় হয়।
কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া জানিয়েছেন, সেখানে ওইদিন দুই লাখ মানুষের ভিড় হয়েছিল। তবে এই সংখ্যা তিন লাখ ছাপিয়ে যায় বলেও ধারণা করছে কেউ কেউ।
এক পুলিশ আধিকারিক বিবিসিকে জানিয়েছেন, স্টেডিয়াম ও বিধানসৌধকে ঘিরে থাকা ভিড় ক্রমে 'উন্মত্ত' হয়ে উঠেছিল।
বিধান সৌধে আইপিএলে জয়ী টিম আরসিবির খেলোয়াড়দের সংবর্ধনা দেন রাজ্যপাল থাওয়ার চাঁদ গেহলোট, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া এবং উপ-মুখ্যমন্ত্রী ডি কে শিবকুমার।
এদিকে, ভিড় বাড়তে থাকে। ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বিবিসি হিন্দিকে জানিয়েছেন, ভিড় সামাল দিতে একসময় লাঠি চার্জ করা শুরু করে পুলিশ।
স্টেডিয়ামে ঢোকার গেটের বাইরে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। ধাক্কাধাক্কিতে অনেকে পড়ে যান এবং পদপিষ্ট হন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একজন কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, যখন এই দুর্ঘটনা ঘটে, স্টেডিয়ামের গেট তখন "খোলাও হয়নি, কিন্তু এত লোক ছিল এবং তারা একটা ছোট গেট দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করছিল। সেই সময় পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটে।"
ছবির উৎস, AFP via Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
আহত এক ক্রিকেটপ্রেমীর শুশ্রূষা করছেন পুলিশ সদস্যরা
বুধবার দুপুরে ওই রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জি পরমেশ্বরের সভাপতিত্বে একটা বৈঠক হয়েছিল। এই মুহূর্তে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক মহলে যে প্রশ্নটা সবচেয়ে বেশি তোলা হচ্ছে তা হলো–– সেই সময় নগর পুলিশের কেউ কেন জানাননি যে এত কম সময়ে ভিক্ট্রি প্যারেডের জন্য সব কিছুর ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়।
আদর্শভাবে পুলিশের পক্ষ থেকে ক্ষমতাসীনদের বলা উচিত ছিল যে এটা (ওই অনুষ্ঠান) সম্ভব নয়। কর্ণাটক স্টেট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন (কেএসসিএ) এবং আরসিবি-র সঙ্গে সমন্বয় তৈরি করা উচিত ছিল।
তাদেরকে পুলিশ অফিসারদের বুঝিয়ে বলা উচিত ছিল যে ওই অনুষ্ঠান হলে কী কী সমস্যা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
তবে এসটি রমেশ বলছেন, পুলিশ কর্মকর্তাদের পক্ষে প্রশাসনের ক্ষমতাবান কাউকে এমনটা স্পষ্টভাবে বলা মোটেই সহজ কাজ নয়।
তার কথায়, "আজ থেকে দু'দশক আগে পর্যন্ত সম্ভব হলেও, আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি আজ গোটা দেশে কোথাও কোনা মুখ্যমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে এটা স্পষ্ট করে বলা সম্ভব নয় যে অমুক কাজ করা তাদের পক্ষে অসম্ভব।"
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পুলিশ কর্মকর্তা বিবিসি হিন্দিকে বলেন, "এটা একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল। এটা (অনুষ্ঠানের অনুমতি দেওয়া) পুলিশের সিদ্ধান্ত ছিল না।"
"আদর্শভাবে, অনুষ্ঠান কয়েক দিন পরে হওয়া উচিত ছিল। ততদিনে ক্রিকেটপ্রেমীদের উন্মাদনা কমে যেত। তখন আপনা থেকেই ভিড় হতো এবং নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে তাদের (ভিড়ের) আচরণ প্রাণঘাতী হওয়া থেকে বাঁচানো যেত।"
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যাখ্যা
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জি পরমেশ্বর অবশ্য সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, গোটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল কেএসসিএ ও আরসিবি। তিনি বলেন, "সরকার শুধু ওই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছে।"
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কংগ্রেস নেতা বলেন, "সরকার যদি শুধু ওই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণই করত তাহলে উপমুখ্যমন্ত্রী ডি কে শিবকুমারকে দলকে স্বাগত জানাতে এইচএএল বিমানবন্দরে যেতে হয়েছিল কেন?"
ওইদিন যারা পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনাকে প্রত্যক্ষ করেছেন, তারা জানিয়েছেন, আরসিবি-র পোর্টাল থেকে বিনামূল্যে পাস পাওয়া যাওয়ায় স্টেডিয়ামের গেটে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছিল।
স্টেডিয়ামের কর্মীরা কাউকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছিলেন না, কারণ ৩২ হাজার আসনের সবগুলোই আগেই পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।
রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর (আরসিবি) পদপিষ্ট হয়ে মৃতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ১০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে।
এদিকে, এই ঘটনায় বেঙ্গালুরু পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। আরসিবির যে কর্মকর্তারা এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাদের মধ্যে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে পুলিশ।