টরন্টোর আকাশচুম্বী কংক্রিটের জঙ্গল, গ্লাস-প্যানেলে মোড়ানো বিলাসবহুল কন্ডো, রো-হাউজ, ডিট্যাচড হোমের সারি—সব যেন এক এক সময় ছিল স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি। কানাডার মধ্যবিত্ত ও অভিবাসী সমাজের জন্য বাড়ি কেনা শুধু আশ্রয় নয়, এটি ছিল আত্মপরিচয়ের চাবিকাঠি, ভবিষ্যতের বিনিয়োগ, অবসরের নিরাপত্তা, এমনকি পারিবারিক মর্যাদার মাপকাঠি। কিন্তু সেই ধারণার এখন ভাঙন শুরু হয়েছে।

২০২৫ সালের গ্রীষ্মে এসে প্রশ্নটা ক্রমেই জোরালো হচ্ছে—টরন্টোর রিয়েল এস্টেট বাজার কি ভেঙে পড়ছে? এক কথায় বললে, না। কিন্তু ভাঙার পথে রয়েছে। তথ্য বলছে, এই পতন ধীর, স্থিতিশীল, কিন্তু গভীরতর।

১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে টরন্টো শহর এক বড় রিয়েল এস্টেট সংকটের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল, যখন গড় বাড়ির দাম ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত কমে গিয়েছিল। এরপর দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে চলতে থাকে এক আশ্চর্য ঊর্ধ্বমুখী ধারা। বিশেষ করে ২০১৫–২০২২ সময়কালে কানাডার হাউজিং মার্কেট হয়ে ওঠে পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বেড়ে ওঠা বাজারগুলোর একটি। টরন্টোতে গড় বাড়ির মূল্য পৌঁছে যায় ১.৩ মিলিয়নের ঘরে, অনেক সময় তা এক বছরে ২৫–৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। করোনার সময় ঘরে বসে কাজের প্রবণতা, স্বল্প সুদের হার এবং বিনিয়োগের বিকল্পের অভাবে রিয়েল এস্টেট হয়ে ওঠে সবচেয়ে লোভনীয় ও নির্ভরযোগ্য সম্পদ হিসেবে।

তবে অতিরিক্ত মুনাফার এই ফেনা খুব বেশি দিন টিকেনি। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দাম সর্বোচ্চ ছুঁয়ে ফেলেছিল। এরপরই শুরু হয় এক দীর্ঘশ্বাসময় পতন।

২০২২ সালের পিকের তুলনায় ২০২৫ সালের জুনে টরন্টো ও আশপাশের এলাকায় গড় বাড়ির মূল্য প্রায় ১৮–২০ শতাংশ কমে এসেছে। কিছু অর্থনীতিবিদ পূর্বাভাস দিচ্ছেন, এই পতন ২৩ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। তবে এটি ১৯৯০-এর দশকের সেই ‘ধস’ নয়, বরং এক পোস্ট-প্যান্ডেমিক কারেকশন।

বর্তমানে টরন্টোর গড় বাড়ির দাম $১.১ মিলিয়ন ডলার, যা ২০১৯ সালের তুলনায় এখনো ৩২ শতাংশ বেশি। ২০১৯ সালে গড় মূল্য ছিল $৮৩৩,০০০ ডলার। অর্থাৎ দাম কমেছে বটে, কিন্তু এখনো সেটা নাগালের বাইরে।

তবে সব এলাকা একরকম নয়। যেমন টরন্টোর Downtown Core (স্পাডাইনা, কিং, ফ্রন্ট স্ট্রিট এলাকা), Liberty Village/Niagara ও Bay Street Corridor (Church-Yonge) এলাকায় গড় মূল্য ২০১৯ সালের নিচে নেমেছে। এসব এলাকায় মূলত স্টুডিও ও ছোট কনডোর ঘনত্ব বেশি, আর সেগুলোর অতিরিক্ত সরবরাহই গড় দামের পতনের মূল কারণ।

এই পতনের মধ্যে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হলো মানুষের মানসিকতা। টরন্টো বিশ্ববিদ্যলয়ের রটম্যান স্কুল অব ম্যানেজমেন্টের Associate Professor Victor Couture বলেন, “আগে মানুষ ভাবতো—বাড়ি মানেই লাভ। কিন্তু এখন তারা বুঝতে পারছে, ‘সব বিনিয়োগ থেকে মুনাফা হয় না।’”

কন্ডো মার্কেট, যা মূলত বিনিয়োগকারীদের উপর নির্ভরশীল ছিল, সেখানে এখন স্থবিরতা। কারণ ভাড়ার আয় দিয়ে মর্টগেজ কাভার হয় না। ফলে বিনিয়োগকারীরা পিছিয়ে যাচ্ছেন, ডেভেলপাররা প্রজেক্ট বাতিল করছেন।

রিয়েল এষ্টেট বিশেষজ্ঞ Royal LePage Signature Realty-এর Tom Storey জানান, ছোট স্টুডিও বা এক বেডরুম কন্ডো এখন ২০১৯ সালের দামে বিক্রি হচ্ছে। তবে দুই ও তিন বেডরুম কন্ডোর চাহিদা এখনো আছে কারণ এমন ইউনিটের সংখ্যা কম। Detached homes এখন ‘ব্যালেন্সড মার্কেট’-এ আর কিছু Semi-detached homes এখনো সেলার্স মার্কেটের চরিত্র বহন করছে।

কিন্তু কন্ডো মার্কেট পুরোপুরি ক্রেতাদের হাতে। জুন ২০২৫-এর তথ্যমতে, টরন্টোতে সক্রিয় তালিকার ৬০ শতাংশই ছিল কন্ডো ইউনিট।

অক্সফোর্ড ইকোনমিক্সের ডিরেক্টর টনি স্টিলো বলেন, “বাজার এখন স্থবির। বিক্রয় গড়ের নিচে, নতুন তালিকা বাড়ছে, কিন্তু ক্রেতা নেই। ফলে দাম কমতে বাধ্য।” মূল্য আরও ১০ শতাংশ কমতে পারে ২০২৫-এর শেষ ত্রৈমাসিক পর্যন্ত।

একই সঙ্গে তিনি সতর্ক করেন—এই পতনকে ‘ক্র্যাশ’ বলা যাবে না। কারণ দাম এখনো অনেক বেশি। “যদি এখন বাজার স্থির হয়ে যায়, তাও মানুষ বলবে দাম খুব বেশি,” বলেন ফিলিপ ক্রস।

Desjardins ব্যাংকের অর্থনীতিবিদ Kari Norman জানান, বাড়ির দাম কমলেও তা এখনো ‘অ্যাফোর্ডেবল’ নয়। গত ২৫ বছরে গড় বাড়ির মূল্য বেড়েছে চার গুণ, আর একই সময় ইনকাম বেড়েছে মাত্র দুই গুণ। ফলে টরন্টোয় অনেক পরিবার তাদের আয়ের ৬৫–৭০ শতাংশ ব্যয় করছে কেবল আবাসনে।

যেখানে আয় ও খরচের ভারসাম্য না থাকে, সেখানে অর্থনৈতিক দুঃসময় আসতে বাধ্য। এবং সেই লক্ষণ ইতিমধ্যে দেখা যাচ্ছে।
অন্টারিওতে ৯০ দিন বা তার বেশি মর্টগেজ বকেয়া থাকার হার ২০২৪-এর প্রথম কোয়ার্টার থেকে ৭১.৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ০.২৪ শতাংশে।
‘Power of sale’ অর্থাৎ মর্টগেজ না পরিশোধের কারণে বাড়ি বিক্রি বেড়েছে, ২০১৮ সালের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন: ১) সুদের হার খুব দ্রুত নামছে না; ২) আন্তর্জাতিক অভিবাসন ধীর গতিতে চলছে; ৩)অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুর্বল। এই তিনটি উপাদান একসঙ্গে বাড়ির দামের উপর চাপ সৃষ্টি করছে। কোনো নাটকীয় পরিবর্তন না ঘটলে দাম আরও কমবে—তবে ধীরে, ধীরে।

টরন্টোর হাউজিং বাজার এখন এক মোহভঙ্গের সন্ধিক্ষণে। বাড়ি আর আগের মতো অলৌকিক মুনাফার উৎস নয়—এটা মানুষের আশ্রয়, নিরাপত্তা ও সম্মানের প্রতীক।

এক সময় ছিল, যখন মানুষ ভাবতো—একবার বাড়ি কিনলেই জীবনধারণ হবে সহজ, ভবিষ্যৎ হবে নিশ্চিত। বাড়ির দাম এমনভাবে বাড়বে, যেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপনিই সম্পদের খনি হয়ে উঠবে। কিন্তু এখন সেই বিশ্বাসে চিড় ধরেছে।

সময় এসেছে নতুন করে ভাবার—ঘর যেন আর মুনাফার খেলায় ব্যবহৃত না হয়। মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই যেন বাজারের তরঙ্গে ভেসে না যায়।

সমাজের দায়িত্ব, সরকারের নীতি, আর আমাদের প্রত্যাশার সমন্বয়েই তৈরি হতে পারে একটি বাস্তব সম্মত, সহনশীল হাউজিং বাজার—যেখানে আয় ও ব্যয়ের মধ্যে থাকবে ভারসাম্য, আর মানুষের স্বপ্ন হবে মাটি ছোঁয়া, আকাশচুম্বী নয়।

(বি. দ্র. এই লেখায় ব্যবহৃত তথ্যাবলি Clarrie Feinstein-এর ২৬ জুলাই ২০২৫ তারিখে টরন্টো স্টারে প্রকাশিত মূল প্রতিবেদন অবলম্বনে সংকলিত।)



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews