শহীদ মাহরিন চৌধুরী; একটি নাম, একটি ইতিহাস; যিনি শিশুদের জীবন বাঁচাতে জ¦লন্ত অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে হাসিমুখে শাহাদাতকে বরণ করে নিয়েছেন-ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। হয়তো ইতিহাস খুঁজলে অনেক আত্মত্যাগের কথা আমরা জানতে পারবো। কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখার দহিকা শক্তির মুখোমুখি হয়ে সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের জীবন রক্ষায় নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার ঘটনা ইতিহাসে বিরল। আর সে বিরল ইতিহাসই সৃষ্টি করে গেলেন ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক ও কো-অর্ডিনেটর শহীদ মাহরিন চৌধুরী। তিনি শুধু শিক্ষকতাকে পেশাই নয়; বরং মাতৃত্বকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, এ মহীয়সী নারী পুরো জাতিকে মাতৃত্বের স্নেহ দিয়ে ধন্য করেছেন; গর্বিত করেছেন পুরো জাতিকেই। আমরা এ শহীদের কাছে কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ, চিরঋণী ও গর্বিত।

শহীদ মাহরিন চৌধুরী শুধুমাত্র একজন শিক্ষিকা ছিলেন না; তিনি ছিলেন এক আদর্শ মা এবং অসীম সাহসী নারী। তিনি জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন শিক্ষকতা শুধুমাত্র জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য পেশা নয় এবং এক মহান ব্রত ও আদর্শের নাম। তার এ আত্মোৎসর্গ প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মনে চিরস্থায়ী ছাপ এবং পুরো শিক্ষক সমাজকে গর্বের আসনে অভিষিক্ত করবে। তিনি আজ আর আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার অদম্য সাহস, মানবতাবোধ, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, মাতৃত্ব ও আত্মোৎসর্গের গল্প প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রেরণা জুগিয়ে যাবে। মাহরিন চৌধুরী প্রমাণ করে গেছেন সত্যিকারের শিক্ষা শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়, তা আত্মত্যাগ ও ভালোবাসার মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপনের মাধ্যমেও বিকশিত হয়। আর এর উজ্জ¦ল দৃষ্টান্ত তিনি নিজেই।

মূলত, শিক্ষক হলেন তাঁরা, যাঁরা শিক্ষাদানের মহান ব্রত পালন করেন। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিতদেরই শিক্ষক বলা হয়। শিক্ষকদের জাতির বিবেক ও জাতি গঠনের কারিগর বলা হয়। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। আর শিক্ষার মেরুদণ্ড হচ্ছে শিক্ষক সমাজ। কারণ, একজন আদর্শ শিক্ষকই পারেন নতুন প্রজন্ম ও শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ, সুন্দর এবং সুকুরমার বৃত্তির চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে এবং একই সাথে জ্ঞানার্জন, ন্যায় ও মূল্যবোধ চর্চার দীক্ষা দিতে। শিক্ষার্থীর মানবতাবোধকে জাগ্রত করে একজন শিক্ষক কেবল পাঠদানকে সার্থকই করে তোলেন না, পাশাপাশি দেশের উন্নয়নকে ত্বরাণ্বিত করেন। স্বীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করে তাদেরকে দেশের যোগ্য ও আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন। আর আমৃত্যু সে মহতি দায়িত্বই পালন করে গেছেন শহীদ শিক্ষিকা মাহরিন চৌধুরী।

একথা কারো অজানা নয় যে, উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ২০ শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করতে গিয়ে গুরুতর দগ্ধ হওয়া শিক্ষিকা মাহরিন চৌধুরী শেষ পর্যন্ত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে। গত ২২ জুলাই রাত সাড়ে ১০টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তিকাল করেন। তিনি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের জুনিয়র শাখার সমন্বয়কারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। দুর্ঘটনার সময় নিজের জীবনকে উপেক্ষা করে তিনি কমপক্ষে ২০ জন শিক্ষার্থীকে আগুনের মধ্যে থেকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান। তবে এ ত্যাগের মূল্য তাকে নিজের জীবন দিয়েই দিতে হয়েছে। তার শরীরের প্রায় ৮০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল বলে হাসপাতাল ও পারিবারিক সূত্রে জানা যায়।

পারিবারিক সূত্রে খবর নিয়ে জানা যায়, তিনি শুধু পেশাগতভাবে একজন আদর্শ শিক্ষক, আদর্শ মা ও আদর্শ নারীই ছিলেন বরং পারিবারিক জীবনেও ছিলেন অনুকরণীয় আদর্শ। শাহাদাতের পর তার পরিবারের সদস্যদের প্রতিক্রিয়ায়ও সে কথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মরহুমার ছোট ভাই মুনাফ মুজিব চৌধুরী তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘আমার বড় বোন ছিলেন মায়ের মতো। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। মাহরিন আপু আমাদের পরিবারের জন্য একজন আদর্শ মানুষ ছিলেন’। মরহুমার স্বামী মনসুর হেলাল বলেছেন, ‘ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত পুড়ে গেছে। সে অবস্থাতেও ও বাচ্চাদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল’। প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য অনুযায়ী, মাহরিন চৌধুরী নিজেকে তুচ্ছ করে বারবার আগুনের দিকে ছুটে গিয়ে শিশুদের উদ্ধার করেছেন। তার সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের কথা শুনে শোকের পরিবেশে অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।

এ মর্মান্তিক ঘটনায় মাহরিন চৌধুরীর মামার আহাজারি পাথর হৃদয়েও কান্নার ঢেউ তুলেছে। মামা-ভাগ্নির এক গভীর ও মধুর সম্পর্ক ছিল, যা এমন আকস্মিক বিয়োগান্তক পরিণতিতে ছিন্ন হয়েছে। তার মামার বুকফাটা আর্তনাদ জীবনের অনিশ্চয়তা এবং প্রিয়জন হারানোর নিদারুণ বেদনাকে আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এ ঘটনা শুধু ঢাকা উত্তরা নয়, পুরো বাংলাদেশের মানুষকে শোকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। নাড়া দিয়েছে বিশ্বের বিবেকবান মানুষকেও।

এ ঘটনার পর শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক, সহকর্মী ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। একজন শিক্ষক কীভাবে নিজের দায়িত্ববোধ থেকে মানবিকতার সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন, মাহরিন চৌধুরী ছিলেন তার জীবন্ত ও জ¦লন্ত উদাহরণ। মাহরিন চৌধুরীর আত্মত্যাগ স্মরণে স্কুল কর্তৃপক্ষ তার নামে একটি স্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কথা ভাবছে বলেও জানা গেছে। তিনিসহ আরো একজন শহীদ শিক্ষককে জাতীয়ভাবে সম্মানিত করার ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে।

​একথা কারো অজানা নয় যে, শিক্ষিকা মাহরিন চৌধুরী, যিনি নিজের জীবন বাজি রেখে ২০ নিষ্পাপ শিশুর প্রাণ বাঁচিয়েছেন। তার এ আত্মত্যাগ মানবতা ও ভালোবাসার এক চিরস্মরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ৮০ শতাংশ দগ্ধ শরীর নিয়েও তিনি তার শিক্ষার্থীদের ছেড়ে যেতে পারেন নি। যেখানে সাধারণ মানুষ নিজের প্রাণ বাঁচাতে সবকিছু ফেলে পালাতে দ্বিধা করে না, সেখানে মাহরিন চৌধুরী শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত তার আদরের শিক্ষার্থীদের রক্ষায় লড়েছেন। তার এ বীরত্বপূর্ণ আত্মোৎসর্গ পুরো জাতিকে শিখিয়ে গেল মানুষের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা এবং দায়িত্বের প্রকৃত অর্থ। তিনি তার আত্মত্যাগের মাধ্যমে নিজেকে বীরঙ্গনা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।

শিক্ষক শুধু পাঠদানের মাধ্যমেই শিক্ষক নন বরং একজন প্রকৃত শিক্ষক হলেন তিনিই, যিনি দায়িত্ব, ভালোবাসা আর আত্মত্যাগের মাধ্যমে জাতি গঠনের বীজ বপন করেন। আমরা পুঁথিগতভাবে ‘আদর্শ শিক্ষক’-এর সংজ্ঞা পড়েছি। কিন্তু বাস্তবজীবনে এমন শিক্ষকের সাথে তেমন পরিচয় আমাদের ঘটেনি। মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজের মহীয়সী শিক্ষিকা ‘মাহরীন চৌধুরী’ আমাদের চোখে দেখিয়ে দিলেন শিক্ষকতা মানে কেবল ক্লাসে পাঠদান নয়, বরং প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার নাম। তিনিই হয়তো সে ব্যতিক্রম, যার হৃদয়ে ভালোবাসা ছিল, দায়িত্ববোধ ছিল, আর সবচেয়ে বড় কথা মনুষ্যত্ব ছিল। মাহরিন চৌধুরীর ছবিগুলো শুধু একটি মুহূর্ত নয়, যেন এক জীবন্ত ও গৌরবোজ্জ¦ল ইতিহাস। আগুনের ভয়াবহতা যখন সবাইকে আতঙ্কিত করে তুলেছে, তখন একজন শিক্ষক হিসেবে নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে করে কোমলমতি শিশুদের রক্ষা করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আগুনের তীব্র উত্তাপ তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে কোন প্রকার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। এখানেই তার প্রকৃত স্বার্থকতা।

তিনি ছিলেন শিক্ষার্থীদের স্নেহময়ী মা, দায়িত্বশীল অভিভাবক, নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল। সবচেয়ে বড় কথা একজন সত্যিকারের আদর্শ মানুষ। আদর্শ ও মানবিক মূল্যবোধ তাকে অনন্য সাধারণ মর্যাদা দিয়েছে। আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায়, এমন আদর্শবান ও মহানুভব শিক্ষক সত্যিই বিরল! যিনি শুধু চাকরি বা জীবন-জীবিকা নয় বরং দায়িত্ববোধ ও ভালোবাসার তাগিদ থেকে এ মহতি পেশাকে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন সে মহীয়সী, বিদূষী ও বিরল ব্যক্তিত্ব, যিনি মৃত্যুর মুহূর্তেও শিক্ষার্থীদের সামনে আগুনের মোকাবেলায় মানবঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন। প্রত্যেক শিক্ষক এমন হওয়াই উচিত; পাঠ্যবই থেকে শুরু করে কর্মজীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে, এমনকি রাজনৈতিক অবস্থানেও। যে দীক্ষা আমাদেরকে দিয়ে গেলেন শহীদ মাহরিন চৌধুরী।

এ অদম্য ও দুঃসাহসী শিক্ষিকা ‘মাহরিন চৌধুরী’ নিজের জীবন দিয়ে আমাদের শেখালেন; আলোকবর্তিকা তুলে দিলেন আমাদের হাতে। শ্রদ্ধা ও ভালবাসা সে মহান শিক্ষিকার প্রতি, যিনি সাহস, মমতা আর আত্মত্যাগের এক অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন এবং তিনি পুরো জাতির কাছেই আম্মাজান হিসাবেই স্বীকৃতি লাভ করেছেন। তার এ আত্মদান শুধু কয়েকজন শিশু বা শিক্ষার্থীর প্রাণ রক্ষার মিশন নয়, বরং হাজারো মানুষের হৃদয়ে মানবতার আলোকবর্তিকা প্রজ্বলিত করেছে এবং শিক্ষক সমাজসহ পুরো জাতিকেই তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত করে গেছেন।

আমরা শহীদ মহীয়সী আম্মাজানকে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ এবং তার রূহের মাগফিরাত কামনা করছি।

[email protected]



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews