বাংলাদেশি পণ্যে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প যে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছেন, তা নিয়ে দর কষাকষি করতে মঙ্গলবার মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে বসতে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল।
তাদের সঙ্গে বসার আগে অবশ্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে ঢাকা। সবশেষ সিদ্ধান্ত হিসেবে মার্কিন কোম্পানি বোয়িংয়ের কাছ থেকে ২৫ উড়োজাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
এর আগে ছয় শতাধিক মার্কিন পণ্যে শুল্কছাড় দেওয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও তেল, গম ও তুলা কেনার কথা জানায় ঢাকা।
কিন্তু এসব সিদ্ধান্তের প্রভাব মঙ্গলবারের আলোচনায় কতটুকু ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন শুল্ক কতটুকু কমবে, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর ওপর শেষমেশ কতটুকু শুল্ক বহাল থাকবে?
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “এটি বুঝতে হলে ভারত, পাকিস্তান, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও চীনের উপর কত হারে শুল্ক আরোপ হয়, সেটা আগে দেখতে হবে।”
সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ইমিরেটস এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে যুক্তরাষ্ট্রের পথে ঢাকা থেকে রওয়ানা দেয় সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল।
এ দলে রয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবুর রহমান ও অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী।
মঙ্গলবার ও বুধবার ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে দর কষাকষিতে বসবেন তারা।
ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে অবশ্য এর আলোচনায় বসে বাংলাদেশ। সবশেষ বৈঠক হয় গত ৯ ও ১০ জুলাই, ওয়াসিংটন ডিসিতে।
ওই বৈঠকেও উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। তবে সেখান থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসার পর গত ২ এপ্রিল শতাধিক দেশের ওপর চড়া হারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। বাংলাদেশের ওপর তখন বাড়তি ৩৭ শতাংশ শুল্কের ঘোষণা আসে।
এ নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে সম্পূরক শুল্ক পুনর্বিবেচনা করতে ডনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি পাঠান বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা তুলে ধরে শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত তিন মাস স্থগিত রাখার অনুরোধ করা হয় সেখানে। তাতে রাজি হয়েছিলেন ট্রাম্প।
এই তিন মাস সময় ট্রাম্প মূলত দিয়েছিলেন আলোচনার জন্য। বাংলাদেশের তরফ থেকেও সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ৬২৬টি পণ্যে শুল্ক ছাড়ের ঘোষণা দেওয়া হয় জাতীয় বাজেটে।
কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। ৩৭ শতাংশের বদলে ট্রাম্প ৩৫ শতাংশ শুল্কের খড়্গ এসেছে বাংলাদেশের ওপর, যা ১ অগাস্ট থেকেই তা কার্যকর হতে পারে।
প্রতিযোগী দেশের শুল্কহার গুরুত্বপূর্ণ
দুই দেশের এমন আলোচনা প্রতিযোগী অন্যান্য দেশকেও স্বস্তি দিতে পারে বলে মনে করছেন জাহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্র চারটি বিষয়ে কথা বলেছে, তার মধ্যে শুল্কারোপ একটি। সরকার ও ব্যবসায়ীরা শুধু শুল্কের দিকটি নিয়েই কথা বলছে। বাকি তিনটি— শ্রম, মানবাধিকার কিংবা মেধাস্বত্ব তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। এখানেও তো অগ্রগতি দেখতে চায় তারা।
“বাংলাদেশের ওপর শুল্কারোপ যেমন হবে, চীন ও আরও কয়েকটি দেশের উপর তো আরো বেশি হতে পারে। কোনো দেশে কম হবে, কোনো দেশে বেশি হবে, যেবস দেশে বেশি হবে, তাদের রপ্তানি হিস্যাটার সুযোগ তো নিতে পারে বাংলাদেশ।”
তিনি বলেন, ‘‘শুধুই যে বাংলাদেশ বাজার হারাতে পারে, তা বলার সময় এখনো হয়নি। অন্যান্য দেশের শুল্কারোপ না দেখে এই সমীকরণের সরল বিশ্লেষণ করা যাবে না। তবে বিশ্ব রপ্তানি বাজারে যে একটা ধাক্কা আসবে, তা অনুমান করা যায়।”
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বছর প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের পোশাক যায় বাংলাদেশ থেকে, যা একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের শীর্ষ বাজার।
রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশই আসে বাংলাদেশের এই পোশাক খাত থেকে।
পোশাক নির্মাতা এইচকেসি অ্যাপারেলস বছরে যে পরিমাণ পোশাক রপ্তানি করে, তার মধ্যে ৯০ শতাংশই যায় যুক্তরাষ্ট্রে।
কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক রাকিবুল আলম চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘আমাদের বা বায়ারদের কিছুই করার নাই। যা করবে ট্রাম্প প্রশাসন করবে, তাদের সিদ্ধান্তে নির্ভর করছে আমাদের অবস্থা কী হবে। ব্যবসা করতে পারব, নাকি পারব না।
“ভারত, কম্বোডিয়া, পাকিস্তান আর ইন্দোনেশিয়া আমাদের কম্পিটিটিভ মার্কেট। তাদের ট্যারিফের সঙ্গে যদি আমাদের ট্যারিফ সমন্বয় করা যায়, ট্রাম্প প্রশাসন যদি এটি করে দেয়, তাহলে চিন্তার কিছুই নাই। সবকিছু তাদের হাতে।”
রাকিবুল আলম বলেন, ‘‘সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত কোনো ধরনের আগাম ধারণা দেয়াটাই ভুল হবে। আমরা এখন অস্থিরভাবে অপেক্ষা করছি কী হবে। বায়াররাও তাকিয়ে আছে পরিস্থিতি জানতে।”
চীনের শুল্ক পেছাচ্ছে ৩ মাস
বাংলাদেশের মত প্রতিযোগী অন্যান্য দেশের ওপরও বর্ধিত হারে শুল্ক আরোপ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। দেশগুলোও নিজেদের মত করে শুল্ক কমিয়ে আনতে চেষ্টা-তদবির চালিয়ে যাচ্ছে।
এর মধ্যে বড় অর্থনীতির দেশ চীনের সঙ্গে শুল্ক যুদ্ধে তিন মাসের জন্য বিরতির ইঙ্গিত দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
রয়টার্স জানিয়েছে, সোমবার সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে সুইডিস প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক হবে।
নতুন শুল্কারোপ বাংলাদেশর ওপর কার্যকর হবে আগামী ১ অগাস্ট থেকে। চীনের ওপর তা ১২ অগাস্ট হওয়ার কথা। কিন্তু সেটা এখন তিন মাসের জন্য পিছিয়েও যেতে পারে।
আগামী অক্টোবরে ডনাল্ড ট্রাম্প ও শি জিনপিংয়ের বৈঠক হওয়ার সূচি রয়েছে। সেই বৈঠকেই পাল্টাপাল্টি শুল্কারোপ নিয়ে নতুন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে দেশ দুটি।
প্রতিযোগীদের কী হাল
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিভাগের অফিস অব টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেল (ওটেক্সা) এর হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক বাজারে প্রথম অবস্থান চীনের।
বাণিজ্য যুদ্ধ চলার মধ্যে চলতি বছরের প্রথম ৫ মাসে দেশটিতে চীনের রপ্তানি ১০ শতাংশ কমে গেছে। এ সময়ে তারা পোশাক রপ্তানি করেছে ৪৮৯ কোটি ডলারের।
তৃতীয় অবস্থান ধরে রাখা বাংলাদেশ চলতি বছরের জানুয়ারি-মে পর্যন্ত সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক পাঠিয়েছে ৩৫৩ কোটি ডলারের, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২১ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি।
এই সময়ে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি ইন্দোনেশিয়ার বেড়েছে ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ, ভারতের ১৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ ও পাকিস্তানের বেড়েছে ২১ দশমিক ৫৮ শতাংশ।