পশ্চিমা সভ্যতা আজ নিঃসন্দেহে বিজয়ীর আসনে। চোখ-ধাঁধানো প্রযুক্তি, অভিনব জীবনদর্শন এবং বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে তারা আজ বিশ্বের নেতৃত্বে। মহাকাশ থেকে সমুদ্রের তলদেশ পর্যন্ত তাদের কর্তৃত্ব বিস্তৃত। ভাষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি এমনকি শিক্ষা-ব্যবস্থাও আজ পশ্চিমা আদর্শে প্রভাবিত। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ন্যাটো, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ প্রায় প্রতিটি বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের রাশ তাদের হাতে। এ যেন আধুনিক উপনিবেশের এক নতুন রূপ— সাংস্কৃতিক ও চিন্তার উপনিবেশ।
এই আধিপত্য কেবল সাংস্কৃতিক নয়; মুসলিম নিধন এখন একটি নিষ্ঠুর বাস্তবতা। আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, ফিলিস্তিন, লিবিয়া, কাশ্মীর, রাখাইন, চেচনিয়া—বিশ্বের প্রায় সব অঞ্চলেই মুসলিমরাই আজ সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত। "সন্ত্রাসবাদ" নামক ছদ্মবেশে ইসলামকে দানব হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। মুসলমানদের রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিকে ভেঙে চুরমার করা হয়েছে। গুপ্তচর সংস্থা, ড্রোন যুদ্ধ, গণমাধ্যম, শিক্ষাব্যবস্থা এমনকি সিনেমাও এখন ইসলামবিদ্বেষী মনোভাবের হাতিয়ার।
পশ্চিমা বিশ্ব যেখানে মানবাধিকারের কথা বলে, সেখানে ফিলিস্তিনে গণহত্যা, রাশিয়ার মুসলিমদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন, ভারতে মুসলিমদের নাগরিক অধিকার হরণ—এসব তাদের নীরবতা প্রশ্নবিদ্ধ করে। একদিকে ফরাসি রাষ্ট্র ইসলাম বিদ্বেষকে "মত প্রকাশের স্বাধীনতা" বলে ঘোষণা করে, অপরদিকে হিজাব পরা মুসলিম মেয়েদের স্কুলে প্রবেশে বাধা দেয়। এ এক নগ্ন দ্বিচারিতা।
আরেকটি গভীর সংকট হচ্ছে মুসলিম যুবসমাজের আত্মপরিচয় হারানো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ফ্যাশন, গান-বাজনা ও পশ্চিমা জীবনধারার প্রচারে আজকের তরুণ প্রজন্ম নিজেদের ঐতিহ্যকে লজ্জার বিষয় মনে করছে। 'মডার্ন' হওয়া মানেই ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়া—এমন এক মনস্তত্ত্ব গড়ে তোলা হচ্ছে।
কিন্তু সব দোষ পশ্চিমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করা যাবে না। আমাদের নিজেদের ভুলও চিহ্নিত করতে হবে। শিক্ষা থেকে বিচ্যুতি, দ্বীনের প্রকৃত শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাওয়া, নেতৃত্বের দুর্বলতা, মতবিভাজন, সাম্রাজ্যবাদীদের দোসর হয়ে কাজ করা কিছু শাসক ও আলিমদের অগ্রহণযোগ্য নিরবতা—এসবই মুসলিম জাতিকে দুর্বল করেছে।
ইসলাম কোনো স্রেফ ব্যক্তিগত ধর্ম নয়—এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। যেখানে রয়েছে ন্যায়ভিত্তিক রাজনীতি, সুদমুক্ত অর্থনীতি, সমাজকল্যাণমূলক রাষ্ট্রনীতি এবং মানবিক মূল্যবোধে গড়া সংস্কৃতি। ইসলামের ইতিহাস প্রমাণ করে—যখন মুসলিমরা কুরআন-সুন্নাহর ছায়ায় ফিরে এসেছে, তখনই তারা দুনিয়ার নেতৃত্ব পেয়েছে। আব্বাসীয়, উমায়্যাদ, উসমানীয় খেলাফত—সবখানেই তা প্রমাণিত।
আজও সম্ভাবনা শেষ হয়নি। মুসলিম জাতির রয়েছে বিশাল জনসংখ্যা, অগাধ সম্পদ, শক্তিশালী ইতিহাস এবং সর্বোচ্চ নৈতিক দর্শন। প্রয়োজন আত্মপরিচয়ে দৃঢ় থাকা, ঐক্যের পুনর্গঠন এবং দ্বীনি শিক্ষা ও প্রযুক্তির সমন্বয়।
পশ্চিমা সভ্যতা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে—সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক সব দিক থেকেই। মুসলমানদের এখনই জাগতে হবে। আত্মপরিচয়ে দৃঢ় হয়ে, কুরআন-সুন্নাহর আলোকে জীবন গঠন করতে হবে। আত্মসমালোচনা, শুদ্ধি, ঐক্য এবং নবজাগরণের মাধ্যমে আবারও মুসলিম উম্মাহ ইতিহাসের নেতৃত্বে ফিরে আসতে পারে। ইসলাম ছিল, আছে এবং থাকবে—আলোকবর্তিকার মতো মানবজাতির সামনে।
লেখক: মুহাম্মদ ফয়সাল, আনোয়ারা, চট্টগ্রাম