ঈদ হলো আনন্দের উপলক্ষ্য। কোরবানির ঈদ মুসলিম বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব, যা ধ্বনিত হয় আত্মত্যাগ ও দানের মহিমায়। এ বিশেষ দিনটি মুসলমানরা পশু কোরবানির মাধ্যমে পালন করেন, যা ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে সম্পন্ন হয়। তবে এ ধর্মীয় আচার পালনের সময় স্বাস্থ্যের বিষয়টাও খেয়াল রাখতে হবে। কথায় আছে- স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। তাই এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ও যত্নবান হতে হবে। কারণ এ সময় ‘রেড মিট’ বা ‘লাল মাংস’ বেশি খাওয়া হয়।

ঈদ আনন্দের। এ সময় বাড়িতে বাড়িতে খাওয়া হবে গরু-খাসির মাংস। আর খাবার মেনুতে অন্য যত কিছুই থাক না কেন, মাংস মুখে না দেওয়া পর্যন্ত কোরবানির ঈদ যেন শুরুই হলো না।

আর খাবারের তৃপ্তি না থাকলে এ আনন্দ যেন পূর্ণতা পায় না। তবে তা হতে হবে পরিমিত। ঈদের উৎসব আনন্দ আগেও ছিল এবং ভবিষ্যতেও চলতেই থাকবে। খাওয়া-দাওয়ারও উৎসব আনন্দ অতিভোজন একইভাবে চলবে। অন্তত একটা দিন হলেও সবার এমন ইচ্ছা থাকে। তারপরও সবাইকে রয়ে-সয়ে খেতে হবে। এ ছাড়া কোরবানির পশু কেনা থেকে শুরু করে পশু জবাই ও খাদ্য গ্রহণের প্রতিটি স্তরে স্বাস্থ্য সতর্কতা মেনে চলতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি এবং নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মেনে চললে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটার আশঙ্কা কমবে এবং এ সময় ঈদ আনন্দময় করে তোলা যাবে।

ঈদ আনন্দের। আর খাবারের তৃপ্তি না থাকলে এ আনন্দ যেন পূর্ণতা পায় না। তবে তা হতে হবে পরিমিত, স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিসমৃদ্ধ। ঈদের উৎসব আনন্দ আগেও ছিল, এখনো চলছে এবং ভবিষ্যতেও চলতেই থাকবে। তবে ঈদ এবং ঈদ-পরবর্তী সময়ে সুস্থ থাকতে হবে, খাবারের বিষয়ে পরিমিতি জ্ঞান, সচেতন ও সংযম পালন করতে হবে। এভাবেই উৎসবও চলতেই থাকবে, স্বাস্থ্যটাও ভালো থাকবে।

কোরবানির ঈদ আনন্দের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো খাবার। অন্যান্য খাবারের সঙ্গে মূল আয়োজনে থাকে বিভিন্ন রকমের মাংসের পদ, যেমন গরু, খাসি, মহিষ এমনকি উটের। এখন দুম্বাও কোরবানি দেওয়া হচ্ছে দেশে। ঈদ উৎসবে অনেকেরই মনের প্রবল ইচ্ছা বেশি করে মাংস খাওয়া। অনেকেই আছেন যারা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে অনেক বেশি মাংস খেতে পছন্দ করেন। আবার এমনও কেউ আছেন যারা মাংসের ক্ষতির প্রভাব মনে করে একেবারেই খেতে চান না। মনে রাখতে হবে মাংসের ক্ষতিকর দিক কিছু আছে সত্য, তেমনি এর কিন্তু যথেষ্ট উপকারও আছে। কারণ মাংস হচ্ছে প্রাণিজ প্রোটিনের অন্যতম উৎস। তবে খাদ্য সচেতনতাও সবচেয়ে বেশি জরুরি। বিশেষ করে যারা দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভোগেন তাদের মনেও খাবার নিয়ে থাকে অনেক সংশয়। এক্ষেত্রে বলা যায়, দু-একদিন বেশি খেতে যদিও খুব বাধা নেই, তবু খাওয়া উচিত রয়ে-সয়ে। সমস্যা হতে পারে যাদের পেটের পীড়া, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা হৃদ্রোগ আছে কিংবা যাদের এসব রোগের প্রাথমিক লক্ষণ আছে। ঈদের সময় সবার বাসায়ই কমবেশি নানা মুখরোচক খাবারের আয়োজন করা হয়। নিজের বাসায় তো বটেই, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের বাসায় এবং বিনোদন কেন্দ্রে ঘুরে ঘুরে সারাদিনই টুকিটাকি এটা-সেটা খাওয়া হয়। যেগুলো আমাদের সংস্কৃতিরই অংশ।

মাংস নিয়ম মেনে পরিমাণ মতো খাবেন : মাংস তো খেতেই হবে তাতে বাধা নেই। মূল সমস্যাটা নিঃসন্দেহে খাবারের পরিমাণে। অনেকেই একসঙ্গে প্রচুর পরিমাণ তৈলাক্ত বা চর্বিযুক্ত খাবার খেয়ে হজম করতে পারেন না। তাছাড়া কোরবানির মাংস পরিমাণে একটু বেশিই খাওয়া হয়। ফলে পেট ফাঁপা, জ্বালাপোড়া, ব্যথা এমনকি বারবার পায়খানা হতে পারে। পর্যাপ্ত পানি পান না করার কারণে অনেকে কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগেন। যদিও কোনো নির্দিষ্ট খাবার খেতে মানা নেই, কিন্তু পরিমাণ বজায় রাখা খুবই জরুরি। এ ক্ষেত্রে শুরু থেকেই পরিকল্পনা থাকা উচিত। যেহেতু দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলেই সবাই মাংস খাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তাই সকাল আর দুপুরের খাওয়াটা কম খেলেই ভালো। অন্য বাসায়ও যথাসম্ভব কম খাওয়া উচিত।

সকালের খাবার : ঈদের সকালে অল্প করে সেমাই বা পায়েস খান। অনেকেই শরবত, কোমল পানীয়, ফ্রুট জুস ইত্যাদি খাওয়া পছন্দ করেন। চেষ্টা করুন মৌসুমি ফল দিয়ে এসব জুস তৈরি করতে। কারণ এসব জুসের কোনো তুলনা নেই। তাতে মজা ও উপকার দুই-ই পাবেন। লেবুর শরবত, বাসায় বানানো ফলের রস, কিশমিশ, বাদাম, ডাবের পানি, বোরহানি ইত্যাদি খাওয়া যায়।

মাংস খাবেন বুঝেশুনে : যাদের বয়স কম, শারীরিক বা হজমেরও কোনো সমস্যা নেই, তারা নিজের পছন্দমতো সবই খেতে পারেন, শুধু অতিরিক্ত না হলেই হলো, বিশেষ করে চর্বিজাতীয় খাদ্য।

কোষ্ঠকাঠিন্য বা পাইলসের সমস্যা : বেশি মাংস খেলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা বেড়ে যায়। যাদের এনাল ফিশার ও পাইলসজাতীয় রোগ আছে, তাদের পায়ুপথে জ্বালাপোড়া, ব্যথা ইত্যাদি বাড়তে পারে, এমনকি পায়ুপথে রক্তক্ষরণও হতে পারে। তাই প্রচুর পরিমাণে পানি, শরবত, ফলের রস, ইসবগুলের ভুসি ও অন্যান্য তরল খাবার বেশি খাবেন।

পেপটিক আলসার বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা : কারও পেটে গ্যাস হলে ডমপেরিডন, অ্যান্টাসিড, ওমিপ্রাজল, প্যান্টোপ্রাজলজাতীয় ওষুধ খেতে পারেন। যাদের আইবিএস আছে, তারা দুগ্ধজাত খাবার পরিহার করুন।

এড়িয়ে চলুন চর্বি : অতিরিক্ত চর্বি খাওয়া এমনিতেই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কোরবানির সময় এ বিষয়টি বিশেষভাবে খেয়াল রাখা উচিত। অনেক সময় দেখা যায়, রান্না সুস্বাদু হবে মনে করে মাংসে বেশ কিছু চর্বি আলাদাভাবে যোগ করা হয়, এসব পরিহার করা উচিত। মাংসের সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণে সবজি খাওয়া যেতে পারে। টাটকা সবজি পাকস্থলী সাবলীল রাখে। পরিমিতিবোধ যেখানে রসনা সংবরণ করতে পারে, সেখানে ভয়ের কিছু নেই। মাংসে তেল বা ঘিয়ের পরিমাণ কমিয়ে দিলে, ভুনা মাংসের বদলে শুকনো কাবাব করে খেলে, কোমল পানীয় ও মিষ্টি একেবারে কমিয়ে খেলে কোরবানির ঈদের সময়ও ভালোই থাকা যায়।

সচেতন থাকতে হবে বয়স্কদের : মধ্যবয়সী এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের খাবার সম্পর্কে সচেতন থাকা আরও জরুরি। এমনকি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে অতিরিক্ত চর্বি ইত্যাদি না থাকা সত্ত্বেও এই বয়সের মানুষের ঈদের খাবারের ব্যাপারে বাড়তি সতর্ক থাকা দরকার। অতি ভোজনে তাদের পেট ভরা ভাব, অস্বস্তিকর অনুভূতি, বারবার ঢেকুর ওঠা এমনকি বুকে ব্যথা পর্যন্ত হতে পারে। বেশি মাংস খেলে তা পরিপূর্ণভাবে হজম হতে সময় লাগে।

ডায়াবেটিস : ডায়াবেটিস রোগীকে অবশ্যই মিষ্টিজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। গরু বা খাসির মাংস পরিমাণ মতো খেতে পারেন, তবে চর্বি না খেলেই ভালো।

অ্যালার্জিজনিত সমস্যা : অনেকেরই গরুর মাংসে অ্যালার্জির ঝুঁকি থাকে, তাদের জন্য গরুর মাংস এড়িয়ে চলাই যুক্তিযুক্ত। যদি কেউ খেতে চান তবে আগে থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খেতে পারেন।

রক্তে উচ্চমাত্রায় কোলেস্টেরল, উচ্চরক্তচাপ, স্ট্রোক এবং হৃদরোগী: অতিরিক্ত গরুর মাংস খেলে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বেড়ে যায়। শুধু গরু নয়, মহিষ, ছাগল ও খাসির মাংসে থাকে উচ্চমাত্রার প্রোটিন ও ফ্যাট। তাই অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত মাংস খেলে স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও কোলেস্টারলের মাত্রা বেড়ে যায়, বিশেষ করে যারা আগে থেকেই এসব রোগে ভুগছেন তাদের ঝুঁকি আরও বেশি। তাই মাংস খাওয়ার সময় অবশ্যই খেয়াল রেখে পরিমিত পরিমাণে এবং চর্বি ছাড়িয়ে খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। সারাবছর তারা যে ধরনের নিয়মকানুন পালন করেন খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে, কোরবানির সময়ও সেভাবে চলাই ভালো।

কিডনির রোগীদের : যারা কিডনির সমস্যায় ভোগেন, যেমন ক্রনিক রেনাল ফেইলিওর, তাদের প্রোটিনজাতীয় খাদ্য কম খেতে বলা হয়। তাই মাংস খাওয়ার ব্যাপারে আরও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কোনোক্রমেই অতিরিক্ত খাওয়া ঠিক হবে না। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সারাবছরের মতো ঈদের সময়ও একই খাবার খাওয়াই ভালো।

মাংস বাদে আর যা যা কম খাবেন বা এড়িয়ে চলবেন : মনে রাখতে হবে, মাংস তো খাওয়া হয়, এর সাথে আরও কিছু মুখরোচক খেতে অনেকেই ভালোবাসেন যেমন কলিজা, মগজ, ভুঁড়ি, পায়া বা নেহারি ইত্যাদি। এগুলোও পরিমাণ মতো খেতে পারেন সাবধানতার সঙ্গে।

ব্যায়াম করতে হবে নিয়মিত : বয়স অনুযায়ী হালকা ব্যায়াম বা হাঁটাহাঁটি করতে ভুলবেন না, শরীর থেকে অতিরিক্ত ক্যালরি কমাতে সহায়ক হবে।

ঈদ আনন্দের। আর খাবারের তৃপ্তি না থাকলে এ আনন্দ যেন পূর্ণতা পায় না। তবে তা হতে হবে পরিমিত, স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিসমৃদ্ধ। ঈদের উৎসব আনন্দ আগেও ছিল, এখনো চলছে এবং ভবিষ্যতেও চলতেই থাকবে। তবে ঈদ এবং ঈদ-পরবর্তী সময়ে সুস্থ থাকতে হবে, খাবারের বিষয়ে পরিমিতি জ্ঞান, সচেতন ও সংযম পালন করতে হবে। এভাবেই উৎসবও চলতেই থাকবে, স্বাস্থ্যটাও ভালো থাকবে।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

এইচআর/এমএফএ/এএসএম



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews