চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানের পর নতুন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের যে উদ্যোগ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হাতে নিয়েছিল, আগামীর নির্বাচিত সরকারের সময়ও তার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তৈরি হয়েছে জুলাই জাতীয় সনদের খসড়া।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন থেকে আসা সব প্রস্তাব বা সুপারিশ দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার নেওয়ার কথা বলা হয়েছে সেখানে।
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সোমবার এই খসড়া হস্তান্তর করা হয়েছে।
খসড়ার ‘অঙ্গীকারনামায়’ সাতটি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। খসড়াটি চূড়ান্ত হলে তাতে রাজনৈতিক দলের নেতা বা প্রতিনিধিদের পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অন্য সদস্যদের সই থাকবে।
এ খসড়ায় জুলাই জাতীয় সনদ তৈরির পটভূমি, ঐকমত্য কমিশনের গঠন ও কার্যক্রম তুলে ধরার পর রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কমিশনের আলোচনায় উঠে আসা প্রস্তাব বা সুপারিশগুলো যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে।
অঙ্গীকারনামার প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “হাজারো মানুষের জীবন ও রক্ত এবং অগণিত মানুষের সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতি ও ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত সুযোগ এবং তৎপ্রেক্ষিতে জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে দীর্ঘ ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রণীত ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত 'জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫' এর পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করব।”
দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “'জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫'-এ দেশের শাসন ব্যবস্থা তথা সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার বিষয়ে যেসব প্রস্তাব/সুপারিশ এই সনদে লিপিবদ্ধ রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন, লিখন ও পুনর্লিখন এবং বিদ্যমান আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিবর্তন, পরিমার্জন, লিখন, পুনর্লিখন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।”
রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকারনামায় বলা হয়েছে, “'জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫'-এ দেশের শাসন ব্যবস্থা তথা সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার বিষয়ে যেসব প্রস্তাব/সুপারিশ এই সনদে লিপিবদ্ধ রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন, লিখন ও পুনর্লিখন এবং বিদ্যমান আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিবর্তন, পরিমার্জন, লিখন, পুনর্লিখন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধন এই সনদ গৃহীত হওয়ার পরে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যে সম্পন্ন করতে এবং এসব সংস্কার টেকসই করতে অঙ্গীকার করছি।”
অঙ্গীকারনামায় বলা হয়েছে, “এই সনদ গৃহীত হওয়ার পর এতে যে সমস্ত প্রস্তাব/সুপারিশ লিপিবদ্ধ রয়েছে সেগুলো পরবর্তী দুই (২) বছর মেয়াদকালের মধ্যে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।”
'জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫' বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষার পূর্ণ নিশ্চয়তা বিধান করার অঙ্গীকার রয়েছে পঞ্চম অনুচ্ছেদে।
খসড়ার অঙ্গীকারনামায় বলা হয়েছে, “'জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫' বাস্তবায়নে এবং এর আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা প্রদানে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ;
“এবং ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সংবিধানে যথাযোগ্য স্বীকৃতি দিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকব।”
পটভূমি
জুলাই জাতীয় সনদ তৈরির পটভূমি হিসাবে খসড়ায় বলা হয়েছে, “১৯৭১ সালে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামজিক সুবিচারের নীতিকে ধারণ করে সংগঠিত মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো গঠনের আকাঙ্ক্ষা বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে তৈরি হয়েছিল দীর্ঘ ৫৩ বছরেও তা অর্জন করা যায়নি।
“কারণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও সংস্কৃতি বিকাশের ধারা বারবার হোঁচট খেয়েছে। বস্তুতপক্ষে, বিগত পাঁচ দশকে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে একদিকে টেকসই ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। অপরদিকে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নামেমাত্র থাকলেও তা অত্যন্ত দুর্বলভাবে কাজ করেছে।
“বস্তুত রাষ্ট্রকাঠামোতে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের সুরক্ষা নিশ্চিতের লক্ষ্যে দলীয় প্রভাবের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর ও বিচারহীনতার সহায়ক হিসেবে পরিচালনা করা হয়েছে।”
২০০৯ সালে একটি দলীয় সরকার রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করলেও ক্রমান্বয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ‘জলাঞ্জলি দিয়ে অগণতান্ত্রিক চরিত্র ধারণ’ করতে থাকার কথা বলা তুলে ধরে পটভূমিতে বলা হয়, “তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সমালোচকদের মানবাধিকার হরণ, গুম, খুন, নিপীড়ন-নির্যাতন, মামলা ও হামলার মাধ্যমে একটি নৈরাজ্যকর ও বিভীষিকাময় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।
“সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্রকে স্বৈরতান্ত্রিকভাবে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বন্দনার জন্য নিবেদিত রাখা হয়। দেড় দশকে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার জনস্বার্থের বিরুদ্ধে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানের বিকৃতি সাধন, বিভিন্ন নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন, নির্বাচনি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা, বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসনকে দলীয়করণ এবং দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুটপাট করে।”
এই পটভূমিকায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বিপুল ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণের ফলে ‘এক অভূতপূর্ব সফল গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত’ হওয়ার কথা তুলে ধরে খসড়ায় বলা হয়, “এতে শাসকগোষ্ঠীর প্রতিহিংসার শিকার হয়ে শিশু ও নারীসহ এক হাজার চারশর বেশি নিরস্ত্র নাগরিক নিহত এবং বিশ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়। তাদের আত্মাহুতি ও ত্যাগের বিনিময়ে এবং জনগণের সম্মিলিত শক্তি ও প্রতিরোধের কাছে স্বৈরাচারী শাসক ও তার দোসররা পরাজিত হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
“এমতাবস্থায় জনগণের মননে রাষ্ট্র-কাঠামো পুনর্গঠনের একটি প্রবল অভিপ্রায় সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্র সংস্কার বিশেষ করে সংবিধানের মৌলিক সংষ্কার, নির্বাচনী ব্যবস্থার পুনর্গঠন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুশীলন, স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা এবং সুশাসিত জবাবদিহিমূলক ও দুর্নীতিমুক্ত সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যার সদ্ব্যবহার করা আমাদের সকলের পবিত্র দায়িত্ব।”
বাস্তবায়ন হবে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন অবশ্য এ সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী হতে পারছেন না।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এ ধরনের অঙ্গীকার আমরা অতীতেও দেখেছি, সেটার প্রেক্ষাপট হয়ত ভিন্ন ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের বাস্তবায়ন শেষমেশ হয়নি।
“এবার এটা দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবায়ন হবে আদৌ হবে কি-না, তা সত্যিকার অর্থে অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা পরবর্তী সরকারের উপর নির্ভর করবে।”
তিনি বলেন, “এখানে সংবিধান পুনর্লিখনের কথা বলা হচ্ছে। সংবিধান সংশোধন, পরিমার্জন হতে পারে, হয়, কিন্তু পুনর্লিখন বলতে কী বোঝানো হচ্ছে তা স্পষ্ট না এখনও।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, “সংস্কার ও জুলাই সনদ প্রণয়নের এই প্রক্রিয়ায় দিকে যদি আমরা তাকাই, তাহলে মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক কিছু সভা-সেমিনার বা আলোচনায় সীমাবদ্ধ ছিল।
“সেখানে সমাজের নানাপ্রান্তের মানুষের অংশগ্রহণের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া দরকার ছিল। কেননা, সামগ্রিকভাবে জনগণই হবে পরবর্তী সরকারকে এটা বাস্তবায়নে বাধ্য করার প্রধান অংশীজন।”
ঐকমত্যের পথযাত্রা
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠনের পর সংস্কার কমিশন গঠন, সুপারিশ প্রণয়ন এবং ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম সংক্ষিপ্ত আকারে জুলাই সনদের খসড়ায় তুলে ধরা হয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম তুলে ধরে সেখানে বলা হয়েছে, “জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তার কাজ শুরু করে। ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখের মধ্যে ছয়টি কমিশনের প্রতিবেদনের ছাপানো কপি সব রাজনৈতিক দলের কাছে প্রেরণ করা হয়।
“এরপর ৫ মার্চ ২০২৫ তারিখে পুলিশ সংস্কার কমিশন ব্যতীত অপর পাঁচটি কমিশনের প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ স্প্রেডশিট আকারে ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে মতামতের জন্য পাঠানো হয়।”
এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার বিষয়ক ৭০টি, নির্বাচন সংস্কার বিষয়ক ২৭টি, বিচার বিভাগ সংক্রান্ত ২৩টি, জনপ্রশাসন সংক্রান্ত ২৬টি ও দুর্নীতি দমন কমিশন বিষয়ক ২৭টি সুপারিশ থাকার কথা বলা হয়েছে জুলাই সনদের খসড়ায়।
সেখানে বলা হয়েছে, “পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো সরাসরি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বাস্তবায়নযোগ্য হওয়ায় সেগুলো স্প্রেডশিটে রাখা হয়নি।
“অপরদিকে, সংবিধান সংস্কার কমিশন ছাড়া অন্য পাঁচটি কমিশনের দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলোর তালিকা সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।”
খসড়ায় বলা হয়েছে, এরপর মোট ৩৫টি রাজনৈতিক দল ও জোট তাদের মতামত কমিশনে পাঠায়, অনেকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণও দেয়। মতামত নেওয়ার পাশাপাশি প্রথম পর্যায়ে ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত ৩২টি দল ও জোটের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মোট ৪৪টি বৈঠক হয়। আলোচনা ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে কিছু দলের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক হয়।
“রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষ করে কমিশন অগ্রাধিকার ও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় মোট ২০টি বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা আলোচনায় মিলিত হয়। এই প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে নিম্নলিখিত 'জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫' রচিত হয়।”
খসড়ায় বলা হয়েছে, “জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে, আমরা অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রতিনিধিরা স্ব স্ব দলের পক্ষ থেকে বিদ্যমান শাসন ব্যবস্থা তথা সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে নিম্নোল্লেখিত কাঠামোগত, আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের ব্যাপারে ঐকমত্যে উপনীত হয়েছি এবং এইসব বিষয়সমূহকে একটি জাতীয় সনদে সন্নিবেশিত করতে সম্মত হয়েছি।
“২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানের বীর শহীদ ও আহতদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ এবং উক্ত গণঅভ্যুত্থানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণকারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতার স্মারক হিসেবে আমরা এই সনদকে 'জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫' হিসেবে ঘোষণা করছি।”
কোথায় কোথায় ঐকমত্য হল?
জুলাই জাতীয় সনদের খসড়ায় ‘ঐকমত্যে উপনীত হওয়ার বিষয়সমূহ’ অংশটি ফাঁকা রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রথম পর্বের আলোচনা এবং চলমান দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা শেষে যে সকল বিষয়ে ঐকমত্য হবে, সেই সকল বিষয় এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
অর্থাৎ সনদে স্বাক্ষরকারীরা নির্বাচনের পর দুই বছরের মধ্যে এসব সংস্কার উদ্যোগ এগিয়ে নিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকবে।
সোমবার পর্যন্ত আলোচনায় ১২টি বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা জানিয়েছেন কমিশনের সহ সভাপতি আলী রীয়াজ। আরো সাতটি বিষয়ে আলোচনার অগ্রগতি হলেও প্রক্রিয়া নিয়ে দলগুলো একমত হতে পারেনি, সেসব বিষয়ে আরো আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।
যে ১২ বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে––
১. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন: এতে অর্থ বিল ও আস্থা ভোট ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে সংসদ সদস্যরা দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন।
২. সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব: সরকারি হিসাব, অনুমিত হিসাব, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিশেষ অধিকার সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি—এই চারটিসহ জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদ সংসদে আসনের সংখ্যানুপাতে বিরোধী দলের মধ্য থেকে দেওয়া হবে। অর্থাৎ বিরোধী দলগুলো সংসদে যে কটি আসন পাবে, তার অনুপাতে সংসদীয় কমিটির সভাপতি পদ পাবে।
৩. নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ: প্রতি আদমশুমারির অনধিক ১০ বছর পরে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণের জন্য সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদের দফা ১ এর ঘ শেষে আইনের দ্বারা একটি বিধান যুক্ত করা হবে। এর অর্থ হচ্ছে সংসদীয় আসন নির্ধারণ করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা।
আশু ব্যবস্থা হিসেবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় যথাযথ দক্ষতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে বিশেষায়িত কমিটি গঠন করার বিষয়ে একমত হয়েছে দলগুলো। এ ক্ষেত্রে যদি কমিটি গঠন হয়ে থাকে তাহলে তা পরিবর্তন করে সেই কমিটিকে দিয়ে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ করা হবে।
৪. রাষ্ট্রপতির ক্ষমা: এ সম্পর্কিত সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও সকল নির্বাহী ক্ষমতার মাধ্যমে ক্ষমার বিষয় সংবিধানে যুক্ত করার সুপারিশে সকল রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে। এই ক্ষেত্রে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রদর্শনের জন্য পাঠানোর আগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মতামত নিতে হবে।
ক্ষমা প্রদর্শনে রাষ্ট্রপতির অধিকার সম্পর্কিত অনুচ্ছেদ ৪৯ এ বলা হয়েছে, কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনালের যেকোনো দণ্ডের মার্জনা বা বিলম্ব, দণ্ড মওকুফ করার অধিকার রাষ্ট্রপতির থাকিবে। এবং আইন দ্বারা নির্ধারিত মানদণ্ড নীতি ও পদ্ধতি অনুসরণ করে ক্ষমতা প্রয়োগ করা হবে। এ অনুচ্ছেদ সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানে নতুন আইন যুক্ত হলে বিগত সময়ে রাজনৈতিকভাবে এই আইনের যে ‘অপব্যবহার’ হয়েছে তা বন্ধ হবে।
৫. বিচারবিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ: রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। এ ক্ষেত্রে সংবিধানের ১০০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের কথা বলা হয়েছে। এই সংশোধনের ফলে রাজধানীতে সুপ্রিম কোর্টের স্থায়ী আসন থাকবে এবং রাজধানীর বাইরে প্রতিটি বিভাগে প্রধান বিচারপতির পরামর্শ ক্রমে এক বা একাধিক বেঞ্চ থাকবে। অর্থাৎ হাই কোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ ঢাকায় থাকার পাশাপাশি প্রতিটি বিভাগীয় শহরে থাকবে।
৬. পর্যায়ক্রমে উপজেলায় পর্যায়ে নিম্ন আদালত স্থানান্তরের সুপারিশের ক্ষেত্রে ছয়টি বিষয় বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সেগুলো হল—
>> জেলা সদরে অবস্থিত সদর উপজেলা আদালত জেলা জজ কোর্টের সঙ্গে সংযুক্ত করা।
>> বিদ্যমান চৌকি আদালত ও উপজেলা আদালতের প্রয়োজনীয় সংস্কার ও অবকাঠামো নির্মাণ করা।
>> জেলা সদরের কাছাকাছি উপজেলায় নতুন আদালত স্থাপন না করা ও প্রয়োজনীয় জরিপ পরিচালনা করা।
>> অবশিষ্ট উপজেলায় জনসংখ্যার ঘনত্ব, ভৌগোলিক অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য, যাতায়াতব্যবস্থা, দূরত্ব, অর্থনৈতিক অবস্থা ও মামলার সংখ্যা বিবেচনায় পর্যায়ক্রমে আদালত স্থাপন করা।
>> অধস্তন আদালতের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করা।
>> আইনগত সহায়তা কার্যক্রম উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা।
৭. জরুরি অবস্থা জারি: সিদ্ধান্ত হয়েছে—মন্ত্রিসভার অনুমোদন নিয়ে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা জারি করবেন। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিরোধী দলীয় নেতা বা তার অনুপস্থিতিতে উপনেতা অংশ নেবেন। কোন অবস্থায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা যাবে, তাও নির্ধারণ করা হয়েছে। জরুরি অবস্থার মধ্যেও কিছু মৌলিক অধিকার স্থগিত করা যাবে না বলেও ঐকমত্য হয়েছে।
৮. প্রধান বিচারপতি নিয়োগ: এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত হয়েছে—আপিল বিভাগের কর্মে জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি। তবে কোনো দল যদি নির্বাচনি ইশতেহারে যুক্ত করে যে জ্যেষ্ঠতম দুজনের মধ্য থেকে একজনকে নিয়োগ দেওয়া হবে, তারা ক্ষমতায় গেলে সে অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন করতে পারবে।
৯. নির্বাচন কমিশন গঠন: একটি নির্বাচন কমিশন থাকবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং আইনে নির্ধারিত সংখ্যক নির্বাচন কমিশনারদের সমন্বয়ে। এদের মনোনয়নের জন্য একটি বাছাই কমিটি গঠিত হবে—যার নেতৃত্বে থাকবেন জাতীয় সংসদের স্পিকার। কমিটির সদস্য হিসেবে থাকবেন ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত), প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা এবং প্রধান বিচারপতির প্রতিনিধি হিসেবে আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি। কমিটি বিদায়ী কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিন আগে প্রার্থী অনুসন্ধান শুরু করবে। যোগ্যতা-অযোগ্যতা, প্রার্থী আহ্বান ও অনুসন্ধান পদ্ধতি নির্ধারিত হবে সংসদে প্রণীত আইনের মাধ্যমে।
১০. প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকা: একই ব্যক্তি একসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান থাকতে পারবেন না, এমন বিধান করার বিষয়ে তিন–চতুর্থাংশ দল একমত হয়েছে। বিএনপিসহ যারা একমত হয়নি তারা জাতীয় সনদে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিতে পারবে।
১১. প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার সীমা: একজন ব্যক্তি তার সমগ্র জীবনে সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন।
১২. স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন: নয় সদস্য বিশিষ্ট কমিশনের চেয়ারম্যান হবেন আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, যার বয়স ৭৫ বছরের ঊর্ধ্বে হবে না। অতিরিক্ত পুলিশ মহা-পরিদর্শকের নিচে এবং ৬২ বছরের ঊর্ধ্বে নয় এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা হবেন কমিশনের সদস্য সচিব।
আলী রীয়াজ বলেছেন, ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা সমাপ্ত হবে বলে তিনি আশা করছেন। সংলাপে যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাবে, সেগুলো নিয়ে ‘জুলাই সনদ’ বা ‘জাতীয় সনদ’ চূড়ান্ত করা হবে।
তবে জাতীয় সনদের যে প্রাথমিক খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোকে মতামত দেওয়ার জন্য পাঠানো হয়েছে, তা নিয়ে সংলাপে আলাদা করে আলোচনা হবে না। মতামত পাওয়ার পর তা সন্নিবেশিত করে চূড়ান্ত করা হবে সনদ। জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের জন্য সংলাপে একটি দিন বরাদ্দ করা হবে।