সরকার গত এক মাসে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহের কতিপয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দুর্নীতির অভিযোগে চাকরি থেকে অপসারণ, অপরটি হচ্ছে এনবিআর ও সচিবালয়ে আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট সচিব পর্যায়ের কয়েকজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাকে পঁচিশ বছর চাকরি পূর্তির কারণে অবসর প্রদান। দুর্নীতির কারণে ব্যাংকসমূহের কর্মকর্তাদের মধ্যে যাদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে তাদের সবার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। তবে মোটামুটিভাবে বিভিন্ন সূত্র থেকে সকলের কাজকর্ম সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা নেয়ার সুযোগ আমার হয়েছে। যাদের চাকরি গেছে তাদের মধ্যে এমন কিছু কর্মকর্তা ছিলেন যাদের চাকরি অনেক আগেই যাওয়া উচিত ছিল। বিলম্বে হলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। আবার চাকরি হারাদের মধ্যে এমন কর্মকর্তা আছেন যাদের সততা, নিরপেক্ষতা ও নীতিনিষ্ঠা সম্পর্কে অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং সার্কেলে কখনও কোনো অভিযোগ শোনা যায়নি এবং এখনও যায় না। তারা কেন চাকরি হারালেন আমার কাছে এটি একটি বিরাট প্রশ্ন হয়ে রয়েছে। সরকার যাদের চাকরিচ্যুত করলেন তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া কী ছিল তা পরিষ্কারভাবে জানতে পারিনি। যতদূর জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর দফতরে তৈরিকৃত একটি তালিকার ভিত্তিতেই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত কতটুকু নিখুঁত হয়েছে সে ব্যাপারে প্রশ্ন তোলার সময় বোধহয় ফুরিয়ে যায়নি।
আমাদের দেশে একটি শাসনতন্ত্র আছে। শাসনতন্ত্রে নাগরিকদের কিছু মৌলিক অধিকার প্রদান করা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আগে তার বা তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ জানানো এবং তার ভিত্তিতে তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ প্রদান অপরিহার্য। ব্যাংকিং খাতের চাকরিচ্যুত কর্মকর্তাদের এ সুযোগ দেয়া হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। আবার দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তাদের সরকারি চাকরি থেকে অপসারণই যথেষ্ট বলে আমি মনে করি না। দুর্নীতিপরায়ণতা বলতে আমরা সাধারণত যা বুঝে থাকি তা হচ্ছে অর্থ আত্মসাৎ, অপচয়, ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতি প্রভৃতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ ও সম্পত্তির ক্ষতি সাধন, ঘুষ নিয়ে মানুষের উপর জুলুম করা এবং অবৈধ পন্থায় সুযোগ-সুবিধা ভোগ ও দায়িত্ব পালনে অবহেলা। এসব অপরাধের জন্যে দেশের দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনে এবং প্রচলিত চাকরি প্রবিধানমালাসমূহে জেল-জরিমানা ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার শাস্তির বিধান রয়েছে।
জাতিকে দুর্নীতিপরায়ন ব্যক্তিদের ক্ষতিকারক তৎপরতা থেকে বাঁচানোর স্বার্থে এবং অপরাপর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যাতে অপরাধে লিপ্ত হতে অনুপ্রাণিত না হয় তার জন্য এ শাস্তি অপরাধীদের পাওনা। আইনের নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় শাস্তি প্রদান না করে তাদের শুধুমাত্র চাকরি থেকে অপসারণ জাতি এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি উভয়ের প্রতি জুলুম করারই নামান্তর। এর অর্থ হচ্ছে একটি সীমাবদ্ধ খাতে দুর্নীতির শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে অবৈধভাবে সম্পদ আহরণ ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা লুণ্ঠনের পর ঐ খাত থেকে তাদের অব্যাহতি দিয়ে বৃহত্তর বেসরকারি খাতে লুণ্ঠন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার জন্য তাদের ওজিএল দিয়ে দেয়া। এটা কিছুতেই কাম্য হওয়া উচিত নয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকিং খাতের যেসব কর্মকর্তা চাকরি থেকে অপসারিত হলেন তাদের অপরাধ, লুণ্ঠিত অর্থের পরিমাণ (যদি থেকে থাকে) এবং তা উদ্ধারের ব্যাপারে গৃহীত সরকারি পদক্ষেপ সম্পর্কে সরকারের কাছ থেকে জনগণের জানার অধিকার রয়েছে। এ তথ্য সরবরাহে সরকারি বিলম্ব সরকারি সিদ্ধান্তকে সন্দেহজনক ও বিতর্কিত করে তুলতে পারে, তা এই সিদ্ধান্ত যতই নিখুঁত ও সময়োপযোগী হোক না কেন।
যে কয়জন সেক্রেটারিকে সরকার কয়েকদিন আগে অবসর গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন তাদের একজনের ব্যাপারে ইতিমধ্যে সচিবালয় কর্মকর্তাদের তরফ থেকে সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে যে, ৯৬ ঘণ্টার মধ্যে যদি অবসর আদেশ প্রত্যাহার করা না হয় তাহলে তারা আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি দেবে। সরকার এদের অবসর গ্রহণের কেন নির্দেশ দিতে গেলেন সে সম্পর্কে তাদের কাছে কী ধরনের উপাত্ত রয়েছে তারাই ভালো জানেন। তবে আমার কাছে বিষয়টি খুব ভালো বলে মনে হয়নি। এদের বিরুদ্ধে সরকার কোনো অভিযোগের কথা বলেননি। আবার তারা স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন কিনা তাও প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়নি। আমি একজন সচিবকে জানি, যিনি প্রশাসক হিসেবে দক্ষতা, নিরপেক্ষতা, গতিশীলতা এবং দেশপ্রেমের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। সিলেটের জেলা প্রশাসক থাকাকালে তার সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে। ঐ সময় তিনি সিলেট জেলার উন্নয়ন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, অবৈধ দখলকারীদের হাত থেকে সরকারি সম্পত্তি পুনরুদ্ধার, হযরত শাহজালাল ও হযরত শাহ পরানের মাযারসহ সিলেট জেলায় অবস্থিত পীর-আউলিয়াদের মাযারে যুগ যুগ ধরে যে অনাচার ও অন্যায় চলছিল তার মূলোৎপাটনে তাকে আমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে দেখেছি। একটি বিদেশি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রধানকে বাংলাদেশ বিরোধী তৎপরতা চালানো এবং সীমান্ত এলাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহের তথ্য সংগ্রহের অভিযোগে তিনি অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে তাকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশত্যাগে বাধ্য করেছিলেন। পরবর্তীকালে উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব কিংবা ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালনে অযোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন অথবা কোনও দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন এ ধরনের অভিযোগে প্রমোশনের মামলায় হেরে গিয়ে যারা তার ‘শত্রু’তে পরিণত হয়েছিলেন বলে শোনা যায় তাদের কাছ থেকেও শোনা যায়নি।
তবে এমন অনেক সরকারি দায়িত্বশীল আছেন যারা দুর্নীতিতে আকণ্ঠ ডুবে আছেন, সরকার গঠিত একাধিক তদন্ত কমিটি যাদের দুষ্কর্মের ফিরিস্তি দিয়ে সরকারের কাছে রিপোর্ট দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে কেন সরকার এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গেলেন তা বোধগম্য নয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে বেশ কিছু কর্মকর্তাকে প্রমোশন দিয়ে একটি নজির স্থাপন করেছেন। পতিত হাসিনা সরকারের দেয়া প্রমোশনপ্রাপ্ত অনেক যুগ্মসচিব/উপ-সচিবকে পোস্টিং দেয়া সম্ভব হয়নি এবং বিনা কাজে ওএসডি করে বসিয়ে রেখে তাদের বেতন দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিজ্ঞ মহল থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে, প্রমোশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অনেকেই দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, সরকারী সম্পদ আত্মসাৎসহ সীমাহীন অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাদের অনেকের অনুকূলে প্রমোশন কমিটির সুপারিশ না থাকা সত্ত্বেও তারা প্রমোশন পেয়েছেন। সরকার কেন এ কাজটি করতে গেলেন আপাত দৃষ্টিতে তা বুঝতে কষ্ট হলেও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে তার মূল দর্শন পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ে; আমলাদের হাতে রাখা। কিন্তু সব আমলা কি সরকারের হাতে ছিলেন? এক শ্রেণীর আমলা আছেন যারা সরকারী দায়িত্ব পালনের চেয়ে বর্তমানে ডোনার এজেন্সিগুলোকে সন্তুষ্ট রাখার কাজেই বেশি ব্যস্ত থাকেন; উদ্দেশ্য চাকরির লিয়েন রেখে কনসাল্টেন্সী বাগানো। আরেক শ্রেণীর আমলা আছেন এনজিও গঠন করে দেশী-বিদেশী সোর্স থেকে অর্থ সংগ্রহ করে টুপাইস উপার্জনের তালে, তারা ত সরকারী কাজ করেন না।
মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী সাহেবদের সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, কর্মশিবিরে বক্তৃতার মুসাবিদা তৈরি করা ছাড়া একশ্রেণীর আমলার হাতে বড় ধরনের কাজ থাকে না বললেই চলে। সত্যিকার অর্থে দেশের জন্যে, জনগণের জন্য, উন্নয়নের জন্য কাজ করার মানসিকতাসম্পন্ন আমলারা অবশ্যই সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়।
যে প্রশ্নটি করেছিলাম, আমলাদের সন্তুষ্ট করার জন্য গণপ্রমোশনের মতো এত বড় ‘উপকারী পদক্ষেপ’ নেয়ার পরও কি আমলারা সরকারের পক্ষে আছেন? উত্তর দেয়াটা বড় মুশকিল। প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে প্রকৃচি-বিসিএস পরিষদের আন্দোলন চলছে অনেক বছর ধরে। মাঠে কাজ আছে বলে মনে হয় না। জেলা প্রশাসক সভা ডাকলে অন্যান্য বিভাগ ও এজেন্সির খুব কমসংখ্যক প্রতিনিধিই সাড়া দেন। থানা পর্যায়েও অগ্রগতি পর্যলোচনা, মূল্যায়ন ও পরিধারণের কাজ শূন্যের কোঠায়। সবাই আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত। উন্নয়ন হচ্ছে, উন্নয়ন হচ্ছে বলে আমরা যত চিৎকার দেই না কেন গ্রামের মানুষ কিন্তু জানেন উন্নয়ন কতটুকু হয়েছে বা হচ্ছে। তাদের যদি কেউ গাধা মনে করে থাকেন তা হলে ভুল করবেন। আবার গাধাদের এখন কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিং গজাতে শুরু করেছে তা অবশ্যই আমাদের স্মরণ রাখা দরকার। গত তিন বছরে এডিপি বাস্তবায়নের অবস্থা শোচনীয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে মন্ত্রী নেই কিন্তু উপদেষ্টারাই মন্ত্রীর কাজ করছেন।
সরকারি কর্মকর্তাদের দাবি কী? সরকার নিশ্চয়ই জানেন। এ দাবির ব্যাপারে সরকার সুস্পষ্টভাবে নিজের স্ট্যান্ড জানিয়ে দিতে পারেন। তা না করে তারা দীর্ঘসূত্রতার আশ্রয় নিয়েছেন। এতে পরিস্থিতি সরকারের প্রতিকূলে যাচ্ছে বলেই আমার মনে হয়। প্রকৃচি-বিসিএস পরিষদের যারা সদস্য তারা সকলেই সরকারি কর্মকর্তা-বৃটিশ আমলে এদের বলা হতো Public Servent- জনগণের খাজনা থেকে এদের বেতন-ভাতা দেয়া হয়। তাদের সেবা করাই এদের কাজ। সরকারি চাকরিতে ট্রেড ইউনিয়নিজমের সুযোগ আছে কি না বিশেষজ্ঞরাই তা বলতে পারেন। তবে আমি বলতে চাই, তাদের দাবির ব্যাপারে সরকার পরিষ্কার কথা না বলে অগ্রপশ্চাৎ চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই আন্দোলনের নেতাদের বিরুদ্ধে অদূরদর্শী পদক্ষেপ পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলতে পারে। সরকার বিষয়টি ভালভাবে চিন্তা-ভাবনা করে দেখবেন বলেই আমি বিশ্বাস করি।