বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ দ্রুত বিকাশমান। শিল্প, কৃষি, প্রবাসী আয়, পরিষেবা খাত—সবকিছু মিলিয়ে আমরা উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশের পথে যাত্রা করছি। কিন্তু এই জাতীয় অগ্রগতির হিসাবের বাইরে থেকে যাচ্ছে এক বিশাল অবদান—নারীদের অবৈতনিক গৃহস্থালি ও যত্নমূলক কাজ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদি নারীদের এই অবদানকে অর্থমূল্যে গণনা করা হতো, তবে তা দাঁড়াত প্রায় ৫ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এই হিসাব যদি জিডিপিতে ধরা হতো, তাহলে ২০২১ সালে জাতীয় আয় অন্তত ১৩.৫৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেত। অর্থাৎ, নারীরা তাঁদের শ্রম ও সময় দিয়ে যে অদৃশ্য মূল্য সৃষ্টি করছেন, সেটি জাতীয় আয় হিসাবের বাইরে থেকে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে একটি পরিবারের টিকে থাকা ও সদস্যদের কল্যাণ নির্ভর করে যে কাজগুলোর ওপর—যেমন রান্না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, শিশু, প্রবীণ বা অসুস্থ মানুষের যত্ন—সেগুলোকে আমরা কাজ হিসেবে গণনা করি না। অথচ ঠিক একই কাজ যদি কোনো কর্মচারী করে, তাকে বেতন দেওয়া হয় এবং তা জাতীয় আয়ের হিসাবেও যুক্ত হয়। কিন্তু যখন গৃহিণীরা করেন, তখন সেটি “ভালোবাসা” বা “দায়িত্ব” হিসেবে দেখা হয়। এর ফলে নারীর শ্রমকে অর্থনীতি ও নীতি নির্ধারণে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয় না।

এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা আমাদের অনেক কিছু শেখায়। জাতিসংঘের সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরেই নারীর অবৈতনিক শ্রমকে অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দিয়ে আসছে। বিশ্বের বহু দেশে “টাইম ইউজ সার্ভে” পরিচালনা করে দেখা হয়েছে, নারীরা প্রতিদিন কত ঘণ্টা অবৈতনিক কাজে ব্যয় করেন। গবেষণা বলছে, বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন নারীরা প্রায় ১২.৫ বিলিয়ন ঘণ্টা অবৈতনিক কাজ করেন। এর বার্ষিক অর্থমূল্য অন্তত ১০.৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। তুলনা করলে দেখা যায়, এই অর্থমূল্য পৃথিবীর বহু দেশের জিডিপির চেয়েও অনেক বেশি।
ভারতের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সেখানকার জিডিপিতে নারীর অবৈতনিক শ্রম অন্তর্ভুক্ত করলে জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি হতো প্রায় ৬০ শতাংশ বেশি। লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতেও নারীর গৃহস্থালি কাজকে মূল্যায়ন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মেক্সিকো ২০১৪ সালে ঘোষণা করে যে তাদের মোট জিডিপির ২৪ শতাংশ আসে অবৈতনিক কাজের মূল্যায়ন থেকে। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও যুক্তরাজ্যেও টাইম ইউজ সার্ভের মাধ্যমে নারীদের অবদানকে দৃশ্যমান করা হয়েছে। এইসব উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, নারীর শ্রমকে জাতীয় আয়ের অন্তর্ভুক্ত করা শুধু ন্যায্যতাই নয়, বরং বাস্তবতাও।

জাতীয় আয়ে নারীর শ্রম অন্তর্ভুক্ত করা মানে শুধু একটি সংখ্যাগত হিসাব বাড়ানো নয়। এটি নারীর মর্যাদা, সমাজের প্রতি সম্মান এবং রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতার স্বীকৃতি। বাংলাদেশের উন্নয়ন কেবল অবকাঠামো, রপ্তানি বা প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভর করবে না, এটি নির্ভর করবে সেই অদৃশ্য শ্রমের মূল্যায়নের ওপর, যা প্রতিদিন কোটি কোটি নারী ঘরে বসে দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের সেই অবদানকে জাতীয় আয়ের অন্তর্ভুক্ত করা আজ জরুরি, এবং এটাই প্রকৃত অর্থে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথ।

বাংলাদেশে বিবিএসের ২০২১ সালের জরিপে দেখা যায়, নারীরা পুরুষদের তুলনায় ৭.৩ গুণ বেশি সময় অবৈতনিক কাজে ব্যয় করেন। বছরে একজন নারী গড়ে প্রায় ২ হাজার ১৪৬ ঘণ্টা সময় দেন গৃহস্থালি ও যত্নমূলক কাজে। এই সময়ের মধ্যে ৮৯ শতাংশ গৃহস্থালি কাজ এবং ৮৬ শতাংশ যত্নমূলক কাজ নারীরাই করেন। পুরুষদের অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে নগণ্য। অর্থাৎ, একটি সমাজকে টিকিয়ে রাখতে নারীরা নিঃস্বার্থ শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু সেই শ্রম অর্থনীতির সূচকে প্রতিফলিত হচ্ছে না।

এখন প্রশ্ন হলো, কেন এই শ্রমকে জাতীয় আয়ে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি? প্রথমত, এটি স্বীকৃতির প্রশ্ন। একজন নারী তাঁর সারাদিনের শ্রম দিয়ে শুধু পরিবার নয়, জাতীয় অর্থনীতিতেও অবদান রাখছেন। কিন্তু সেই অবদানকে যখন অর্থনৈতিক সূচকে গণনা করা হয় না, তখন তা সামাজিকভাবেও অবমূল্যায়িত হয়। দ্বিতীয়ত, জাতীয় আয়ে এই অবদান অন্তর্ভুক্ত হলে অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র সামনে আসবে। আজ আমরা জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে গর্ব করি, কিন্তু যদি নারীর শ্রমকে ধরা হয়, তবে এই প্রবৃদ্ধি আরও বেশি হবে। তৃতীয়ত, এটি নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ। বাজেট প্রণয়নের সময় নারীর শ্রমের মূল্যায়ন করলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা, শিশু যত্নকেন্দ্র ইত্যাদি বিষয়ে অধিক বিনিয়োগ করা সহজ হবে।

নারীর অবৈতনিক শ্রমকে অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে কিছু বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। প্রথমত, আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় কাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যাতে নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালয় এবং পরিসংখ্যান ব্যুরো একসাথে কাজ করতে পারে। দ্বিতীয়ত, শ্রমনীতি, সামাজিক সুরক্ষা নীতি এবং বাজেটে যত্নমূলক কাজকে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। তৃতীয়ত, বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করতে হবে। যেমন, ডে কেয়ার সেন্টার, বৃদ্ধাশ্রম, এবং প্রতিবন্ধী সহায়তা কেন্দ্র স্থাপনে বিনিয়োগ করলে নারীরা কিছুটা হলেও অবকাশ পাবেন এবং অর্থনীতিতে তাঁদের সক্রিয় অংশগ্রহণ বাড়বে। চতুর্থত, কেয়ার-সম্পর্কিত চাকরিগুলোকে মর্যাদাপূর্ণ ও স্বীকৃত করা প্রয়োজন, যাতে এটি নারীর জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সামাজিক মানসিকতার পরিবর্তন। যতদিন না আমরা বুঝতে পারছি যে গৃহিণীর শ্রমও একটি “কাজ”, ততদিন অর্থনৈতিক সূচকে এর প্রতিফলন ঘটানো কঠিন হবে। সন্তান প্রতিপালন, প্রবীণের যত্ন, রান্না বা ঘরের অন্যান্য কাজ কোনোভাবেই “অমূল্য” নয়, বরং এগুলোর নির্দিষ্ট মূল্য আছে, যা অন্য কেউ করলে টাকা দিয়ে পরিশোধ করতে হতো।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীর শ্রমকে জাতীয় আয়ে অন্তর্ভুক্ত করা শুধু নারীর সম্মানবোধ বাড়াবে না, এটি অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও সামাজিক উন্নয়নেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বলছে, যেখানে নারীর শ্রমকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, সেখানেই সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের জন্যও এটি সময়ের দাবি।

পরিশেষে বলা যায়, জাতীয় আয়ে নারীর শ্রম অন্তর্ভুক্ত করা মানে শুধু একটি সংখ্যাগত হিসাব বাড়ানো নয়। এটি নারীর মর্যাদা, সমাজের প্রতি সম্মান এবং রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতার স্বীকৃতি। বাংলাদেশের উন্নয়ন কেবল অবকাঠামো, রপ্তানি বা প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভর করবে না, এটি নির্ভর করবে সেই অদৃশ্য শ্রমের মূল্যায়নের ওপর, যা প্রতিদিন কোটি কোটি নারী ঘরে বসে দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের সেই অবদানকে জাতীয় আয়ের অন্তর্ভুক্ত করা আজ জরুরি, এবং এটাই প্রকৃত অর্থে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথ।

লেখক : “দ্য আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট, আমি কি এক কাপ কফিও খাবো না, দ্য সাকসেস ব্লুপ্রিন্ট ইত্যাদি বইয়ের লেখক, করপোরেট ট্রেইনার, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্র্যাটেজিস্ট।

এইচআর/এএসএম



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews