বিভিন্ন পত্রিকান্তরে জানা যায় যে, আগামীতে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বয়সের কোন উর্ধ্বসীমা থাকবে না। নিবন্ধনধারী হলে অধিক বয়স্করাও বেসরকারি শিক্ষক হতে পারবেন। অর্থাৎ সরকারি ও অন্যান্য চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নির্ধারিত বয়সসীমা অতিক্রম করলেও বেসরকারি শিক্ষকতায় প্রবেশ করা যাবে।
অপরদিকে আগে থেকেই আরো একটি বিধান আছে যে, বেসরকারি শিক্ষক হবার শিক্ষাগত যোগ্যতায় একটি তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণি গ্রহণযোগ্য হবে। যদিও সরকারি এমনকি অনেক প্রাইভেট কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতায় কোনো তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণি গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের নিয়োগের বাছাই প্রক্রিয়াও উন্নত হয় এবং অধিক মেধাবীরা নির্বাচিত হয়। অথচ ওইসব প্রথম ও দ্বিতীয় বিভাগ বা শ্রেণিধারীদের তৈরি করার দায়িত্ব শিক্ষকদের! কী অদ্ভুত! তুলনামূলক কম যোগ্য শিক্ষকরা তৈরি করবেন বেশি যোগ্য নাগরিক!
শুধু বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা, বয়স সীমা ও বাছাই প্রক্রিয়া অন্যদের তুলনায় শিথিল করা হলে এর অর্থ এমন দাঁড়ায় না যে বেসরকারি শিক্ষক তুলনামূলক কম যোগ্য হলেও চলে? এতে কি তাদের মান ও মর্যাদা হ্রাস পায় না? দেশের ৯৫ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থীদের পাঠদানকারী বেসরকারি শিক্ষকদের অধিক যোগ্য হওয়া কি অধিক গুরুত্বপূর্ণ নয়? তারা তো আমাদের সন্তানদেরই শিক্ষক হয়। তারা অধিক যোগ্য হলেই তো আমাদের সন্তানরা অধিক যোগ্য হবার সম্ভাবনা অধিক থাকে। সাধারণত যে দেশের শিক্ষক যত বেশি যোগ্য হয় সে দেশের নাগরিক তত বেশি যোগ্য হয়। আমাদের শিক্ষকগণ তুলনামূলক কম যোগ্য হলে নাগরিকগণ তুলনামূলক অধিক যোগ্য হবে কীভাবে? একজন কম যোগ্য শিক্ষক তো সারা শিক্ষকতা জীবনে তৈরি করেন অগণিত কম যোগ্য নাগরিক! দ্রুত বেকার সমস্যার সমাধান ও শিক্ষক পদের শূন্যতা পূরণের লক্ষ্যে যদি বিভিন্ন দিক ছাড় দেওয়া হয় এবং এতে তুলনামূলক কম যোগ্যরা নিয়োগ প্রাপ্ত হয় তো তারা কিন্তু থেকে যাবে দীর্ঘদিন। অর্থাৎ নিকট ভবিষ্যতে চাইলেও এ সকল পদে আর অধিক যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হবে না।
বর্তমানে শিক্ষক পদে অধিক যোগ্য প্রার্থীর সংখ্যা তো মোটেও কম নয়; বরং শূন্য পদের তুলনায় অনেক অনেক বেশি। গত ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনে আবেদনকারী ছিল ১৮ লাখ ৬৫ হাজার। অথচ তখন পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তিতে শূন্য পদের সংখ্যা ছিল ৯৬ হাজার ৭৩৬ টি। তাহলে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ অন্যান্য বিষয়ে এত শিথিলতা বলবৎ রাখার প্রয়োজন কী? যারা যত বেশি কঠিন পরীক্ষা দিয়ে ভালো রেজাল্ট করে নির্বাচিত হন তারা তত বেশি মূল্যায়িত হন, মর্যাদাবান হন। এক্ষেত্রে কেউ যদি এমন যুক্তি খাড়া করতে চান যে, তুলনামূলক কম যোগ্যদের আবেদন করার সুযোগ দেওয়া হলেও অধিক যোগ্যরাই নির্বাচিত হবেন। সুতরাং তাদের আবেদন করার সুযোগ দিলে অসুবিধা নেই। এমন যুক্তি কিন্তু সামরিক/ বেসামরিক কর্মকর্তা ও সরকারি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও দেওয়া সম্ভব, কিন্তু সেখানে আমরা দিচ্ছি না! অর্থাৎ সরকারি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা, বয়স সীমা ও বাছাই প্রক্রিয়া শিথিল করা হচ্ছে না। (শিক্ষক বাছাই কালে ডেমো ক্লাস দেখা উচিত।) তারাও কিন্তু আমাদের সন্তানদেরই পাঠদান করেন। সকল সরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা কিন্তু বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের তুলনায় অগ্রগামী নয়। অথচ সরকারি শিক্ষকদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদা বেসরকারি শিক্ষকদের তুলনায় অনেক বেশি।
বেসরকারি শিক্ষকদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা সামান্য বৃদ্ধি করা হলে আরো অনেক বেশি যোগ্য প্রার্থী বেসরকারি শিক্ষক হতে আগ্রহী হবেন। সেটি করা খুবই জরুরি। তা না করে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের যোগ্যতা, বয়সসীমা ও বাছাই প্রক্রিয়া সরকারি শিক্ষক নিয়োগের তুলনায় অহেতুক শিথিল রাখার/করার ফলে এমন প্রমাণ থেকে যাচ্ছে না যে সরকারিদের তুলনায় বেসরকারি শিক্ষকগণ কম গুরুত্বপূর্ণ, কম যোগ্য ও কম মর্যাদাবান! তাই তারা সরকারিদের তুলনায় আর্থিক সুযোগ-সুবিধা ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা কম পাবেন এটাই স্বাভাবিক! এমনকি ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির জন্য বেসরকারি শিক্ষকগণ দাবি-দাওয়া করতে গেলেও বারবার এ কথা তুলে ধরা হয়, তুলে ধরা হবে এবং বঞ্চিত করা হবে। বেসরকারি শিক্ষকগণ জোর গলায় বলতে পারবেন না যে, আমরাও সরকারিদের মত সমান যোগ্যদের, সমান বয়সীদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুসারে আবেদন করে তেমন বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই নিয়োগ প্রাপ্ত হয়েছি। তাই আমাদের সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদা তাদের সমান হতেই হবে।
এমতাবস্থায় অধিক যোগ্য প্রার্থীদের সোচ্চার হওয়া আবশ্যক যে, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগের অনুরূপ শিক্ষাগত যোগ্যতা, বয়স সীমা ও বাছাই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বেসরকারি শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হোক। অর্থাৎ শূন্য পদের বিপরীতে সরাসরি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে উত্তম বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উত্তম প্রার্থী বাছাই করে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হোক। বর্তমানে নিবন্ধনধারী অধিক যোগ্যদের নিয়োগ দিয়ে নিবন্ধন প্রক্রিয়া থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসা হোক। নিবন্ধনধারী সবাইকেই যদি নিয়োগ দিতে হয় তাহলে এটিকে নিবন্ধন পরীক্ষা না বলে নিয়োগ পরীক্ষা বলা ও কার্যকর করা অধিক যুক্তিযুক্ত নয় কি? তুলনামূলক কম নম্বর প্রাপ্ত নিবন্ধন ধারীরাও নিয়োগের দাবিদার হয়, নিয়োগের জন্য সোচ্চার হয়, বয়সের শিথিলতা দাবি করে, অশান্তি তৈরি করে। অথচ নিয়োগ পরীক্ষায়/ প্রক্রিয়ায় কম নম্বর পেয়ে বাদ পড়ে যাওয়ারা আর নিয়োগের দাবিদার হতে পারে না, বয়সের শিথিলতা দাবি করতে পারে না, অশান্তি তৈরি করতে পারে না।
অপরদিকে একবার নিবন্ধন পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া, আবেদন নেওয়া, পরীক্ষা নেওয়া, তালিকা করা, সনদ দেওয়া এবং পরবর্তীতে আবার নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া, বাছাই করা, তালিকা করা, নিয়োগ করা ইত্যাদি নিয়োগ কর্তৃপক্ষ ও নিয়োগ প্রার্থী উভয়ের জন্যই দ্বিগুণ কষ্টসাধ্য ও সময় সাপেক্ষ। তদুপরি নিয়োগ প্রার্থীর জন্য দ্বিগুণ ব্যয় সাপেক্ষ। অধিক সংখ্যক শূন্য পদে নিয়োগ প্রার্থীদের বাছাই কেন্দ্রীয়ভাবে দ্রুত সম্পন্ন করা সম্ভব না হলে জেলা প্রশাসকগণের দায়িত্বে ঐ জেলার সরকারি স্কুল-কলেজের সুযোগ্য শিক্ষকগণের সহযোগিতা নিয়ে সারাদেশে একই প্রশ্নে ও প্রক্রিয়ায় বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের বাছাই দ্রুত সম্পাদন করা সম্ভব। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর তো গতবারও ১৩,০৯,৪৬১ জন আবেদনকারী থেকে ৩২,৫৭৭ জন নিয়োগের বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে।
কিছুদিন পরপর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ করা হলে বারবার ফ্রেশ ক্যান্ডিডেট পাওয়া যাবে। একজন ইয়ং এনার্জিটিক মেধাবী শিক্ষক প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে তৈরি করতে ও পূর্ণ উদ্যমে দীর্ঘদিন পাঠদান করতে যতটা সক্ষম একজন বয়স্ক লোক ততটা সক্ষম না হওয়াই স্বাভাবিক। তাই আলোচিত বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে অধিক যুক্তিযুক্ত উন্নত নীতিমালা প্রণয়ন করে ঢেলে সাজানো উচিত সকল শিক্ষক নিয়োগের বাছাই প্রক্রিয়া। মূল্যায়নে বিবেচনা করা উচিত প্রার্থীর শিক্ষা জীবনের কর্মকাণ্ড ও ডেমো ক্লাসের মান। দ্রুত দূর করা উচিত একই দায়িত্ব-কর্তব্যে নিয়োজিত সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, বয়স সীমা, বাছাই প্রক্রিয়া এবং আর্থিক সুযোগ-সুবিধা সংক্রান্ত সকল বৈষম্য।
লেখক: অধ্যক্ষ, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
এইচআর/এএসএম