এখনকার নারীদের সাধারণ হরমোনজনিত সমস্যা পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম (পিসিওএস) বা ডিম্বাশয়ে সিস্টজনিত জটিলতা। এর ফলে ঋতুচক্র হয়ে পড়ে, মুখে ব্রণ বাড়ে, ওজন যায় বেড়ে। এ লক্ষণগুলো অনেকে পাত্তা দেন না। কিন্তু এসব থেকে দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়তে পারে। পিসিওএস শুধু প্রজননস্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে না, বরং ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং মানসিক চাপও বাড়ায়। তাই আগে থেকেই সচেতনত হওয়া ও প্রাথমিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
পিসিওএস সচেতনতার মাস সেপ্টেম্বরে এ নিয়ে কথা বলেছেন শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অবস অ্যান্ড গাইনি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ডা. শাহিন আখতার জাহান হাবিব। পিসিওএসের উপসর্গ, ঝুঁকি, চিকিৎসা ও জীবনধারার পরিবর্তনের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।
জাগো নিউজ: পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম বা পিসিওএস আসলে কী?
শাহিন আখতার জাহান হাবিব: পিসিওএস হলো নারীর একটি হরমোনজনিত সমস্যা। এ অবস্থায় ডিম্বাশয়ে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়, ফলে ছোট ছোট সিস্ট তৈরি হতে পারে এবং মাসিকচক্র অনিয়মিত হয়। এর প্রভাব শুধু প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর সীমাবদ্ধ নয়, সার্বিক শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও পড়ে।
জাগো নিউজ: এ সমস্যা কোন বয়সে শুরু হয় বা বেশি দেখা যায়?
শাহিন আখতার জাহান হাবিব: পিসিওএস বেশ সাধারণ একটি সমস্যা। ধারণা করা হয়, প্রজননে প্রস্তুত প্রতি ১০ জন নারীর মধ্যে প্রায় ১-২ জন এতে আক্রান্ত হন। এটি সাধারণত ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী নারীর মধ্যে বেশি দেখা যায়।
জাগো নিউজ: পিসিওএস-এর প্রধান উপসর্গগুলো কী। অবহেলায় কী ক্ষতি হতে পারে?
শাহিন আখতার জাহান হাবিব: অনিয়মিত মাসিক, অতিরিক্ত চুল গজানো, ঘাড়ের পেছনে কালো দাগ, মুখ বা শরীরে ব্রণ, মাথার চুল পাতলা হয়ে যাওয়া, ওজন দ্রুত বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি প্রধান লক্ষণ। এগুলোকে অবহেলা করলে দীর্ঘমেয়াদে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
জাগো নিউজ: মাসিক অনিয়মিত হলে, ওজন বেড়ে গেলে বা মুখে ব্রণ উঠলেই কি ধরে নেওয়া যায় যে সে পিসিওএসে আক্রান্ত?
শাহিন আখতার জাহান হাবিব: সব সময় নয়। এসব উপসর্গ অন্য কারণেও হতে পারে। তবে লক্ষণগুলো দীর্ঘদিন ধরে থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত, যাতে সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায়।
জাগো নিউজ: দীর্ঘমেয়াদে পিসিওএস নারীদের প্রজনন ও সার্বিক স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ?
শাহিন আখতার জাহান হাবিব: এটি শুধু সন্তানধারণের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি করে না, বরং ডায়াবেটিস, স্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগের মতো দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার ঝুঁকি বহুগুণ বাড়ায়। তাই একে হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়।
জাগো নিউজ: চিকিৎসা বা নিয়ন্ত্রণে করণীয় কী?
শাহিন আখতার জাহান হাবিব: নিয়মিত ব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর খাবার, ওজন নিয়ন্ত্রণ করলে অনেক ক্ষেত্রে ওষুধ ছাড়াই উপসর্গগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তবে অনেক সময় ওষুধের প্রয়োজন হতে পারে, সেটি নির্ভর করে রোগীর অবস্থা অনুযায়ী। কারণ এখন পিসিওএসকে বলা হয় লাইফস্টাইল ডিজিজ, জীবনযাত্রা পরিবর্তন করতে পারলে এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশি নারীদের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে বাধা কোথায় দেখেন?
শাহিন আখতার জাহান হাবিব: প্রথমত সচেতনতার অভাব। অনেক নারী এই রোগকে গুরুত্ব দেন না বা লজ্জার কারণে কাউকে জানান না। দ্বিতীয়ত, চিকিৎসকের কাছে দেরিতে আসেন। আবার অনেকে ভয় পান যে, হয়তো সন্তানধারণে অক্ষম হয়ে যাবেন, তাই এ নিয়ে কথা বলতে চান না। তাছাড়া দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা হওয়ার ফলে অনেকে হতাশ হয়ে পড়েন। এই সমস্যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলে হয়। শহরের মায়েরা অনেক সচেতন। তারা সামান্য সমস্যা হলেই সন্তানকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যান।
জাগো নিউজ: অনেকে মনে করেন পিসিওএস মানেই সন্তানধারণে অক্ষমতা। এটি কতটা সত্য?
শাহিন আখতার জাহান হাবিব: পিসিওএস মানেই সন্তানধারণে অক্ষমতা, এটা ঠিক না। পিসিওএস থাকলেও বেশিরভাগ নারী সঠিক চিকিৎসা ও জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে সন্তানধারণ করতে সক্ষম হন। সময় মতো চিকিৎসা নেওয়াই মূল বিষয়।
জাগো নিউজ: নারীদের জন্য আপনার বিশেষ পরামর্শ কী, বিশেষ করে যারা এখনো বিষয়টি নিয়ে দ্বিধায় আছেন?
শাহিন আখতার জাহান হাবিব: নারীদের প্রথমেই মাসিকচক্রকে গুরুত্ব দিতে হবে। কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে দেরি না করে বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। এ ছাড়া স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা ধরে রাখা, নিয়মিত ব্যায়াম করা এবং মানসিক চাপ কমানো খুবই জরুরি। বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। সবচেয়ে বড় কথা, পিসিওএসকে কলঙ্ক হিসেবে না দেখে একে একটি চিকিৎসাযোগ্য সমস্যা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
জেএস/আরএমডি/এএসএম