ছবির উৎস, Kaushik Adhikari
ছবির ক্যাপশান,
মুর্শিদাবাদের সহিংসতার জন্য 'বাংলাদেশ থেকে আসা দুষ্কৃতকারী' এবং বিএসএফকে দোষ দিচ্ছেন মমতা ব্যানার্জী, সংঘর্ষের ফাইল ছবি
Author,
অমিতাভ ভট্টশালী
Role,
বিবিসি নিউজ বাংলা, কলকাতা
২৭ মিনিট আগে
পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে গত সপ্তাহে যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হয়েছে, তাতে 'বাংলাদেশি দুষ্কৃতকারী' জড়িত থাকার অভিযোগ করছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। একইসঙ্গে ওই সহিংসতার জন্য ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী এবং বিজেপিকেও দায়ী করেছেন তিনি।
পশ্চিমবঙ্গের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের সঙ্গে কলকাতায় এক পূর্ব নির্ধারিত বৈঠকে বুধবার মমতা ব্যানার্জী এই কথাগুলো বলছিলেন।
বৈঠকটি আগে থেকেই ঠিক করা থাকলেও গত সপ্তাহে মুর্শিদাবাদে নতুন ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদ বিক্ষোভ দিয়ে যে সহিংসতা শুরু হয়েছিল এবং গত শনিবার যে তা সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় বদলে যায়, এই প্রসঙ্গেই মমতা ব্যানার্জী কথা বলবেন এমনটাই আশা করা হচ্ছিল।
মমতা ব্যানার্জী ওই সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে 'পূর্ব পরিকল্পিত দাঙ্গা' বলে অভিহিত করেছেন এবং বিজেপিকে নিশানা করেছেন।
মুখ্যমন্ত্রী তার বুধবারের বক্তৃতার বেশিরভাগ অংশটাই দেন হিন্দিতে। মনে হচ্ছিল যেন অ-বাংলাভাষী মুসলমানরাই তার ভাষণের প্রধান লক্ষ্য।
এর প্রত্যুত্তরে বিজেপি প্রশ্ন তুলেছে, মুর্শিদাবাদে সহিংসতার অভিযোগে যে ২০০র বেশি মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছেন, তার মধ্যে কতজন বাংলাদেশি, সেই সংখ্যা প্রকাশ করা হোক।
কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল এবং সামাজিক মাধ্যমে অনেকে মন্তব্য করছেন যে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য করায় মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কড়া আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হোক।
ছবির উৎস, Mamata Banerjee/FB
ছবির ক্যাপশান,
পশ্চিমবঙ্গের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের সভায় বুধবার ভাষণ দিচ্ছেন মমতা ব্যানার্জী
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে মমতা ব্যানার্জী বলেন, "আপনি বাংলাদেশের পরিস্থিতি জানেন না? আপনি ইউনূসের সঙ্গে গোপন মিটিং করুন, চুক্তি করুন। দেশের ভালো হলে খুশি হব। কিন্তু আপনাদের প্ল্যানিংটা কী? কোনো এজেন্সির মাধ্যমে ওখান থেকে লোক নিয়ে এসে দাঙ্গা করা?
মুখ্যমন্ত্রীর অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে এই ভাষণের লাইভ দেখানো হয়।
সংবাদ সংস্থা এএনআইয়ের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেলের একটি পোস্টের প্রসঙ্গে মমতা ব্যানার্জী বলেন, "কাল আমি এএনআই-এর একটি টুইট দেখেছি, হোম মিনিস্ট্রির সোর্স কোট করে বলেছে যে ইসমে বাংলাদেশ কা হাথ হ্যায়।"
মমতা ব্যানার্জীর বক্তব্যের শেষ অংশটি হিন্দিতে, যার অর্থ হলো এতে বাংলাদেশের হাত আছে।
বিএসএফ সম্পর্কে মমতা ব্যানার্জী বলেন, "যদি এই সহিংসতায় বাংলাদেশের হাত থাকে, তাহলে তার দায় তো কেন্দ্র সরকারের। সীমান্ত সামলানোর দায়িত্ব বিএসএফের। রাজ্যের হাত নেই এতে।"
মুর্শিদাবাদের সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টতা এবং বিএসএফের দায় নিয়ে এই একই কথা ভাষণের শেষ দিকে আরও একবার বলেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।
"আপনারা অ্যালাউ করলেন কেন? বিজেপির লোক কীভাবে বাইরে থেকে এসে গন্ডগোল পাকিয়ে পালিয়ে গেল," প্রশ্ন মমতা ব্যানার্জীর।
এদিনের ভাষণে মমতা ব্যানার্জী একাধিকবার এই মন্তব্যও করেছেন যে মুর্শিদাবাদের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা "বিজেপির পরিকল্পনা"।
তার কথায়, "এটা সম্পূর্ণভাবে পূর্বপরিকল্পিত দাঙ্গা। আমিও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অনেক তথ্য পাচ্ছি।"
"বাইরে থেকে গুণ্ডা নিয়ে আসার পরিকল্পনাটা বিজেপির। প্রথমে ওদের পরিকল্পনা ছিল রাম-নবমীর দিনের। কিন্তু আপনারা সেই পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়েছেন," বলেছেন মিজ ব্যানার্জী।
কলকাতার বৈঠকে হাজির ইমাম-মুয়াজ্জিনদের উদ্দেশ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, "আপনারা শান্ত থাকুন। বিজেপির প্ররোচনায় পা দেবেন না। ইমামদের একটা ভূমিকা পালন করতে হবে। আমি কিন্তু খুঁজে বার করব সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ কাকে কাকে হাত করেছে এবং কিছু বাচ্চা ছেলেকে দিয়ে পাঁচ-ছয় হাজার টাকার বিনিময়ে ইঁট ছুঁড়িয়েছে।"
ছবির উৎস, Polash Singha
ছবির ক্যাপশান,
মুর্শিদাবাদের সহিংসতার ছবি - ফাইল ছবি
বাংলাদেশিদের সম্পৃক্ত থাকার ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী যে অভিযোগ তুলেছেন, তার জবাবে বিজেপি বলছে, মুর্শিদাবাদে সহিংসতার অভিযোগে পুলিশ যতজনকে গ্রেপ্তার করেছে তার মধ্যে কতজন বাংলাদেশি?
দলটির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অন্যতম মুখপাত্র কেয়া ঘোষ বিবিসি বাংলাকে বলেন, "দুশোর বেশি মানুষ তো গ্রেপ্তার হয়েছে পুলিশের হাতে। এদের মধ্যে কতজন বাংলাদেশি ধরা পড়েছে, প্রকাশ করুন মুখ্যমন্ত্রী।
"যে দুই হিন্দু খুন হয়েছেন – পিতা-পুত্র – তাদের হত্যার অভিযোগে যে দুই ভাইকে ধরেছে পুলিশ তারা তো স্থানীয় মানুষ! বাংলাদেশি এল কোথা থেকে! তবে যা খবর পেয়েছি অপরিচিত বহু মুখই সহিংসতায় ভাগ নিয়েছিল – মুর্শিদাবাদেরই এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে তাদের পাঠানো হয়েছিল যাতে স্থানীয় মানুষ চিনে না ফেলতে পারেন," বলছিলেন কেয়া ঘোষ।
আর ওই সভায় বিএসএফের সম্বন্ধে মুখ্যমন্ত্রী যা বলেছেন তা "অত্যন্ত আপত্তিকর", মন্তব্য মিজ. ঘোষের।
তার কথায়, "যারা দিনরাত পরিশ্রম করে আমাদের সীমান্ত সুরক্ষিত রাখে, তাদের নামেও তিনি এরকম একটা অপরাধমূলক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ করলেন? আমার তো মনে হয় বিএসএফের উচিত তার বিরুদ্ধে কড়া আইনি ব্যবস্থা নেওয়া।"
"মুর্শিদাবাদের সহিংসতায় তড়িঘড়ি বিএসএফকে কারা ডেকে এনেছিল? তার জেলা শাসকই তো বিএসএফকে মাঠে নামিয়েছিলেন, নাহলে পুলিশের পক্ষে ওই মব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছিল না। ওই জেলা শাসক সঠিক কাজই করেছিলেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছেন বিএসএফকে," বলছিলেন কেয়া ঘোষ।
ছবির উৎস, BSF
ছবির ক্যাপশান,
উপদ্রুত এলাকায় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলছেন বিএসএফের এডিজি পূর্ব কমাণ্ড রবি গান্ধী (বাঁয়ে)
মুর্শিদাবাদের সহিংসতা রুখতে প্রাথমিকভাবে পুলিশ প্রশাসন যে ব্যর্থ হয়েছিল, তা প্রকাশ্যেই বলতে শুরু করেছেন ওই জেলার তৃণমূল কংগ্রেসের জনপ্রতিনিধিরা।
যদিও সহিংসতা শুরু হওয়ার কয়েকদিন পরেই মুর্শিদাবাদে পৌঁছে গিয়েছিলেন রাজ্য পুলিশের সর্বোচ্চ কর্তারা এবং দ্রুত গ্রেপ্তারও শুরু হয়েছিল।
তবে প্রাথমিকভাবে প্রশাসনিক ব্যর্থতা ছিল বলে তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়করাই মন্তব্য করছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভাশিস মৈত্র বলছিলেন, "ওয়াকফ আইন নিয়ে প্রতিবাদ যে এতটা সহিংস হয়ে উঠতে চলেছে, সেটা আগাম না জানতে পারা তো গোয়েন্দাদের ব্যর্থতাই। এর আগে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধেও এই একই অঞ্চলে সহিংস প্রতিবাদ হয়েছিল। তাহলে এবার কেন গোয়েন্দারা খবর পেলেন না?"
"এখন পরিস্থিতি অবশ্য নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে পুলিশ আর কেন্দ্রীয় বাহিনী। কিন্তু অগ্রিম খবর না জানা এবং প্রথম দিন থেকেই নিয়ন্ত্রণ না করতে পারার ফলেই ঘটনাক্রম সাম্প্রদায়িক মোড় নিয়ে নিল বলেই মনে হচ্ছে," বলছিলেন মি. মৈত্র।
এই সাম্প্রদায়িক সহিংসতার 'ঘোলা জলে সব দলই মাছ ধরতে নেমেছে' বলেও মন্তব্য করছেন তিনি।
তার কথায়, "আগামী বছর নির্বাচন। তার আগে ভোটারদের মধ্যে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় মেরুকরণের প্রচেষ্টা তো হবেই। একদিকে বিজেপি চেষ্টা করবে হিন্দু ভোট একজোট করতে আর উল্টোদিকে মমতা ব্যানার্জীও মুসলমান ভোট ধরে রাখার চেষ্টা করবেন।"
প্রসঙ্গত, সংশোধিত ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যসহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়ও গত কয়েকদিন ধরেই বিক্ষোভ চলছে। কলকাতায়ও বিক্ষোভ হয়েছে।
গত সপ্তাহে মঙ্গল ও বুধবার মুর্শিদাবাদের রঘুনাথপুর ও সুতি থানা এলাকায় সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়। কয়েকটি মুসলিম সংগঠনের বিক্ষোভের পরে এই দুটি থানা এলাকায় পাঁচ জনের বেশি জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ওই এলাকায় ইন্টারনেট পরিষেবাও বন্ধ করে দেয় প্রশাসন।
এক দিন পর শুক্রবার আবার পরিবেশ অশান্ত হয়ে ওঠে। শনিবার মুর্শিদাবাদে তিন জন নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করে পুলিশ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পরে বিএসএফ নামানো হয়।