বাংলাদেশে জুলাই গণঅভ্যুত্থান অনেক বড় পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল। রাষ্ট্রের আমূল পরিবর্তনের স্বপ্ন ছিল তাতে। অনেকেই একে বলছিলেন বিপ্লব, তবে দিনের পর দিন তেমনটা বলা লোকের সংখ্যা কমছে। আমূল পরিবর্তনের জন্য যেসব আমূল সংস্কার প্রয়োজন তা কী এবং কীভাবে করতে হবে সেসব নির্ধারণের জন্য দেশ-বিদেশ থেকে লোক আনা হয়। কিন্তু মানুষ ধৈর্য্য হারাতে থাকে। অনেকে আর সংস্কার নয়, নির্বাচন চায়। ফলে প্রধান উপদেষ্টাকে বলতে হয়, আগামী জুনের মধ্যে নির্বাচন দেয়া হবে।
একদিক থেকে বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে দেশের মানুষ সত্যিকার নির্বাচনের অধিকার হারিয়েছিল। একটা প্রজন্মই গড়ে উঠেছিল নির্বাচনহীনতা ও নির্বাচনের নামে প্রহসন দেখে দেখে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে একটি দুর্নীতিপরায়ণ, আত্মতুষ্ট, গণবিচ্ছিন্ন লুটেরা গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল, যারা ক্ষমতায় থাকার নৈতিক শক্তি ও ভিত্তি হারিয়ে ফেলেছিল। ক্রমাগত জবরদস্তি ছাড়া তাদের ক্ষমতায় থাকার অন্য কোনো উপায় ছিল না। সামরিক সরকারেরও একটা স্পষ্ট পরিচিতি থাকে। তাদের এমন কিছু ছিল না— তারা পরিণত হয়েছিল ‘ভোটবিহীন গণতান্ত্রিক’ সরকারে, কাঁঠালের আমসত্ত্বের মতো।
সংস্কার যতই কেবল কথার ফুলঝুরিতেই সীমিত হয়ে পড়ছে, মানুষের নির্বাচনের দাবিটি ততই জোরালো হচ্ছে। সময় যতই গড়িয়ে যাচ্ছে সংস্কারহীন অবস্থায়, সংস্কার নিয়ে হৈচৈ ততই প্রতিভাত হচ্ছে নির্বাচন পেছানোর অজুহাত হিসেবে। এটাও সত্য যে, নির্বাচনও আমাদেরকে কোনো নৈতিক বোধসম্পন্ন দেশপ্রেমিক সরকার উপহার দেয়নি। তাই নির্বাচিত সরকারগুলোকেও গণআন্দোলনের মুখোমুখি হতে হয়েছে এবং প্রতিটি ক্ষমতা হস্তান্তরপর্বই একটি বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। দেশবাসীকে ওই অস্থিরতা থেকে উদ্ধারের জন্য ও একই সঙ্গে উন্নয়নের জাহাজ চলমান রাখবার জন্য বিগত সরকার আবিষ্কার করেছিল এক অভিনব পদ্ধতি— ভোটারহীন ভোট পদ্ধতি। রাজনৈতিক সরকারগুলোর কোনো আবিষ্কারই ফেলনা যায় না। যে কোনও কানুন কালা না ধলা তা নির্ধারণ করে আপনি ক্ষমতার ভেতরে না বাইরে তার ওপর।
ফলে ক্ষমতার রদবদল হলেও সব কালাকানুন কেবল টিকেই যায় তা নয়, আরও শক্তিশালী হয়ে দেখা দেয়। এটাই ক্ষমতার মাহাত্ম্য! যে ক্ষমতা কালাকে সাদা ও সাদাকে কালা বানাতে না পারে, তা কোনো ক্ষমতা না— থাকলেও কী, না থাকলেও কী! যারা ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার জানে না তারা ক্ষমতা গ্রহণের যোগ্যই নয়। আমাদের গর্ব যে আমাদের সব ক্ষমতাসীনই ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহারে যারপরনাই পারঙ্গম, তাই ডনাল্ড ট্রাম্পও আমাদের ছাত্র হবার যোগ্য!
সে যাই জোক, এখন আগে সংস্কার, না আগে নির্বাচন— এই প্রশ্নটা ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’ এই প্রশ্নের মতোই কঠিন ও জটিল হয়ে পড়েছে। এর কারণ, কী সংস্কার হবে তা আমরা জানি না, আবার একটি সুষ্ঠু শান্তিপূর্ণ ন্যায়পরায়ণ নির্বাচন যা একটি দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব তৈরি করবে তা কীভাবে আয়োজন করতে হয় তাও ভালো জানি না। কিন্তু সাদা চোখে আমরা এটুকু বুঝতে পারি যে, এটি পতিত সরকারের আমল থেকে ভিন্ন হতে হবে। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কাছে ইন্ডিকেটর হচ্ছে বিগত আমল থেকে ভিন্নতা। বিগত স্বৈরাচারী আমলের তথাকথিত উন্নয়নের বৈশিষ্ট্য কী ছিল তার একটা তালিকা পাওয়া যায় অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদের ডেভেলপমেন্ট রি-এক্সামিনড (ইউপিএল, ঢাকা ২০২১) বইটির উপসংহারে।
আনু মুহাম্মদ কর্তৃক চিহ্নিত রাষ্ট্রের এই বৈশিষ্ট্যগুলো হলো: ১) রাষ্ট্র দিনদুপুরে যথেচ্ছ ক্ষমতা চর্চার এবং লুটেরা গোষ্ঠীর হাতে সম্পদ কুক্ষিগত করার যন্ত্রে পরিণত হচ্ছে। ২) সামরিকায়ন, নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের অদৃশ্য জাল সম্প্রসারণ। ৩) গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ব্যবসা ও ক্ষমতার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হচ্ছে। ৪) গণস্বার্থ রক্ষার জন্য সৃষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বিলুপ্ত হচ্ছে। ৫) এনজিও ও সুশীল সমাজের কর্পোরেটায়ন। ৬) ব্যক্তিগত খাতে জনসম্পদ তুলে দেওয়া। ৭) জননিরাপত্তা ব্যবস্থার বাণিজ্যকীকরণ। ৮) পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি ও ধ্বংসসাধন, নদী-হাওড়-বন দখল ইত্যাদি। ৯) গণমাধ্যম হয়েছে যুদ্ধ, নজরদারি, দমন, নির্যাতন, নিপীড়ন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য সম্মতি উৎপাদনের কারখানা। ১০) ক্রসফায়ার নামে রাষ্ট্রপরিচালিত হত্যাকাণ্ড, গুম, অবৈধ আটক ইত্যাদি বাস্তবায়ন এবং আইন ও আইনি প্রক্রিয়াকে মাফিয়া গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি করা।
এই ইন্ডিকেটরগুলো দিয়ে সহজেই বোঝা যায়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির গতিপথে দিকের কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি হয়নি। সাধারণ মানুষের মনেও কিছু ইন্ডিকেটর থাকে ক্ষমতার রদবদলকে মূল্যায়নের জন্য। ওই মূল্যায়নের পরিমাপকগুলো হচ্ছে সাধারণত বাজারে জিনিসপত্রের দাম, রাস্তাঘাটে চলাচলে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ইত্যাদি। উপরোক্ত অনেকগুলো ইন্ডিকেটরের বিচারে চলতি অন্তর্বর্তী সরকার আশানুরূপ অগ্রগতি সাধন করতে পারছে না। আর সেটাই একধরনের অস্থিরতা তৈরি করে চলেছে।
বিগত সরকারের ‘উন্নয়ন’ অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে এবং সেগুলো প্রধানত কাদের স্বার্থ হাসিল করেছে তা লক্ষণীয়। এবার ‘সংস্কার’ও কিছু প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে এবং সেগুলো কাদের স্বার্থে তাও বিবেচনাযোগ্য। বিগত নির্বাচিত অগণতান্ত্রিক সরকারের উন্নয়ন আর বর্তমানের অনির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের সংস্কার দুই-ই যদি একইরকম প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে এবং রূপে-রঙে-কর্মে সমধর্মী হয় তবে এ জাতির দুর্ভাগ্যের কোনোদিনই শেষ হবে না।
আনু মুহাম্মদের ওই বইটির শেষ পৃষ্ঠায় পূর্বে লিখিত প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজলে বর্তমান সংস্কারের ও ভবিষ্যৎ সরকারের (নির্বাচিত বা অনির্বাচিত যাই হোক) উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য একটা চলনসই দিকনির্দেশনা পেতে পারি: জিডিপি বৃদ্ধি, কোন মূল্যে? মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, কতজনের জন্য? আকাশচুম্বী অট্টালিকা ও শপিং মল, কত মূল্যে? গাড়ির সংখ্যা ও রাস্তায় জ্যাম বৃদ্ধি, গণপরিবহনের কী হাল? বড় বড় প্রকল্প ঋণ ও পরিবেশ বিনাশ, কাদের জন্য? আয়ের পরিমাপে দারিদ্র্য দূরীকরণ, জীবনমানের কী অবস্থা? বড় বড় বিনিয়োগ, কী মূল্যে ও কাদের স্বার্থে?
তিনি লিখেছেন, “এ লক্ষ্যে আমাদেরকে চলতি আদর্শিক বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের শক্তিকে জাগাতে হবে সন্ত্রাসের ভয়ের, লুণ্ঠনের, ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণের ও জনগণের সম্পদ ডাকাতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য। মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারকে রাজনীতির ও উন্নয়নচিন্তার কেন্দ্রে স্থাপনের জন্য এবং দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য এটা জরুরি।”
চার বছর আগে প্রকাশিত এ বইটির প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োজনীয়তা এখন যেমন আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। যত তাড়াতাড়ি এ বইয়ের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে ততই দেশের মঙ্গল। ডিম আগে না মুরগি আগে জাতীয় প্রশ্নের চালাকি জাতীয় স্বার্থে আগে বাদ দেয়া প্রয়োজন।