কত আদরেরই না ছিল তারা। সেই স্নেহ- ভালোবাসা-ভরসা, আস্থা-বিশ্বাসের প্রায় ষোলো আনাই বরবাদ করে দিয়েছে। তাও অতি অল্প সময় এক বছর না যেতেই। চাঁদা-বখরা-তদবির থেকে শুরু করে ধর্ষণসহ যৌন অপরাধ কিছুই বাদ নেই। যারা ফ্যাসিস্ট তাড়িয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়তে অকাতরে জীবন দিয়েছে, চরম নির্যাতন সয়েছে, অক্লান্ত পরিশ্রম করছে, তাদের এমন অধঃপতন ভাবতে কষ্টকর।

তাদের চাঁদাবাজির কিছু তথ্য ঘুরছিল বেশ কিছুদিন ধরে। এরপরও ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার একটি মানসিকতা ছিল অনেকের। সমন্বয়ক, সহ-সমন্বয়ক ইত্যাদি পরিচয়ে তাদের নানান অপকর্মের গোপন ও নীরব দর্শক অনেকেই। পুলিশসহ অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছেও জোগাড় হচ্ছিল তথ্যাবলি। কিন্তু, উপরের দিকের মনোভাব জানা দরকার ছিল। এক পর্যায়ে গত সপ্তাহে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কিছু নির্দেশনা পাঠান। এরপরই চাঁদাবাজি, হাদিয়াবাজি ও ক্রাউডবাজির বিরুদ্ধে অ্যাকশন।

চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেফতার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আবদুর রাজ্জাক ওরফে রিয়াদ প্রতীক মাত্র। রাজধানীর গুলশানে সাবেক এক সংসদ সদস্যের বাসায় চাঁদাবাজির ঘটনায় গ্রেফতার রিয়াদের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সেনবাগে। সেখানে তার পাকা ভবন তৈরি করা হচ্ছে। প্রায় আড়াই মাস আগে ভবনটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। গত সপ্তাহে দেওয়া হয়েছে ছাদ ঢালাই। তার আরেক পরিচয় বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। সংগঠনটি তাকে বহিষ্কার করেছে। গুলশানে সাবেক সংসদ সদস্য শাম্মী আহমেদের বাসা থেকে রাজ্জাকসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়।

তারা নতুন রাষ্ট্র চায়, সংবিধান চায়। কিন্তু দুর্নীতি-চাঁদাবাজি বন্ধ চাইলো না। তারা সরকারকেও একটা আপদে ফেলে দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান নোবেলজয়ী ড. ইউনূস ছাত্রদের নিয়োগকৃত। ক্ষমতায় এলেন তাদের পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে। প্রথম কাজটিই তিনি করতে পারলেন না বা করলেন না। ছাত্রদের ক্লাসে ফেরাতে পারলেন না। ছাত্ররাও আর বই-খাতামুখী হলো না।

এ মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিয়াদসহ চারজনের রিমান্ড চলছে। দেশে এই কিসিমের আরও রিয়াদ পয়দা হয়েছে গত ১০-১১ মাসে। গুলশান তথা রিয়াদের ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটি ছাড়া সারাদেশের সব কমিটির কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা দেওয়া হয়। আমাদের ছাত্র-কিশোর-যুবকদের জন্য সম্মানের হলো গোটা বিষয়টি? কত আদর-মায়া-সম্ভাবনার ছিল তারা?

গোটা রাজনীতি সমালোচিত হয়ে পড়াসহ নানানে কারণে গত টানা বছর-দশক কয়েক মেধাবী ছাত্রের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ কমে গেছে। এসএসসি-এইচএসসিতে মোটামুটি রেজাল্ট করলেই সন্তানকে বিদেশ পাঠিয়ে দেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। এই সন্তানরাও উচ্চশিক্ষা শেষে আর দেশমুখী হতে চাচ্ছিল না। আর যাদের বিদেশ পাঠানোর সামর্থ্য নেই, তারা দেশেই সতর্ক থেকেছেন তাদের সন্তান যেন রাজনীতিতে না জড়ায়। ভালো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সেই বাস্তবতায় প্রচার করতে থাকে, তারা রাজনীতিমুক্ত।

চব্বিশের অভ্যুত্থান চিত্র বদলে দেয়। রাজনীতি ঘৃণা করা তারুণ্য তথা শিক্ষার্থীদের নিয়ে নতুন আশাবাদ জন্ম নেয়। রাজনীতিতে মেধাবীদের সংযোগ ঘটবে বলে ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দেয়। তরুণদের উত্থানকে এদেশের মানুষ মনে প্রাণে গ্রহণ করেছে। প্রবল ক্ষমতাবান ফ্যাসিস্টকে যারা হটিয়েছে, পরাজিত বলে কোনো শব্দ তাদের জানা ছিল না। এমন শানিত প্রতিজ্ঞায় দীপ্তমানদের অল্পতেই মারাত্মক বিপর্যয়।

তারা নতুন রাষ্ট্র চায়, সংবিধান চায়। কিন্তু দুর্নীতি- চাঁদাবাজি বন্ধ চাইলো না। তারা সরকারকেও একটা আপদে ফেলে দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান নোবেলজয়ী ড. ইউনূস ছাত্রদের নিয়োগকৃত। ক্ষমতায় এলেন তাদের পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে। প্রথম কাজটিই তিনি করতে পারলেন না বা করলেন না। ছাত্রদের ক্লাসে ফেরাতে পারলেন না। বললেন না ভালোভাবে পড়াশোনা শেষ করতে। ছাত্ররাও আর বই-খাতামুখী হলো না।

গত জুলাইয়ে যারা সক্রিয়ভাবে নেতৃত্বে থেকে রাস্তায় ছিল এই জুলাইয়ে সেই তারাই আসামির কাঠগড়ায়। সচিবালয়ে প্রতিটা মন্ত্রণালয়ে অংশীদারত্বের নামে ছাত্রদের বসানো হয়েছে। গ্রেফতার রিয়াদও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সদস্য। আরও আগে থেকেই বলাবলি হচ্ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্ট বা সেকেন্ড ইয়ারে পড়া ছাত্র কীভাবে বিভিন্ন উপদেষ্টার অফিসে বসে, যাতায়াত করে?

এরকম সময়ই ঢাকার হাজারীবাগে এনসিপির এক নেতা বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে এক নারীকে ধর্ষণের খবর। ওই ভিকটিম এ অভিযোগ নিয়ে কয়েকদিন ধরে থানায় ঘুরছেন। কিন্তু পুলিশ তার মামলা নিচ্ছে না। মামলা না নেওয়ার জন্য চাপ দিতে এনসিপির কয়েকজন নেতা থানায়ও গিয়েছিল। এর আগে এক নারীর সঙ্গে এনসিপির মেধাবী-চৌকস নেতা তুষারের নোংরা টেলিফোন কনভারসেশন মানুষকে হতবাক করেছে।

ঘটনার পরম্পরায় এখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটি ছাড়া সারাদেশের সব কমিটির কার্যক্রম স্থগিতে কি ফয়সালা আসবে? তাদের নিরাপত্তারও একটা বিষয় রয়েছে। তাদের এমন সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে অন্যরা কী করবে? বা করতে পারবে? প্রসঙ্গক্রমে চলে আসে জেনারেল এরশাদের কথা। তিনি অতিষ্ঠ হয়ে এক পর্যায়ে নিজ দলের ছাত্রসংগঠন বাতিল করে দেন।

পড়াশোনার জন্য অন্যান্য দলের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছিলেন, ছাত্রসংগঠন নিষিদ্ধ করে দিতে। কেউ তা করেনি। এবার একটু ভিন্নতা আছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম একেবারে নিষিদ্ধ করা হয়নি। কেন্দ্র ঠিক থাকবে। নিষিদ্ধ কেবল ঢাকার বাইরে। অবস্থা কিছুটা এক সময়ের বস টেইলার্সের মতো। তার বিজ্ঞাপনী প্রচার ছিল, তাদের কোথাও কোনো শাখা নেই। একমাত্র হেড অফিসেই সব!

কর্মীদের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে কেন্দ্র বাদে সারাদেশে সব কমিটি স্থগিত করে ছাত্রদের এ সংগঠনটি কোন ভবিষ্যৎ বরণ করে একটু অপেক্ষা করে দেখার বিষয়। তবে, নতুন এ প্রজন্মের কেউ বিকাশে, কেউ নগদে, কেউ বা বাসায় ঢুকে যা দেখালো, তা অতীত নয়, বর্তমানেই ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলো। অভ্যুত্থানের বছর পূর্তিতে এসে তাদের এমন দশা ধারণাও ছিল না।

কারা বা কোন শক্তি তারুণ্যকে এভাবে অধঃপতিত করলো ভাবনার বিষয় রয়েছে। আদালতে আইনজীবীরা কয়েকজন সমস্বরে বলেন, এদের গডফাদারদেরও ধরতে। সম্ভব হবে তো? বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ানো সংগঠনটির আলোচিত মুখপাত্র উমামা ফাতেমার দেওয়া তথ্য বলছে, কাজটি বড় কঠিন। কারণ ওদের শেকড় খুব গভীরে।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।

এইচআর/এমএফএ/জিকেএস



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews