বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী জানিয়েছেন, গত আট মাসে ৩০টি অগ্রাধিকার উদ্যোগের মধ্যে ২৫টিতে অগ্রগতি হয়েছে। শুক্রবার (৬ জুন) নিজের ফেসবুকে তিনি জানান, ১৮টি উদ্যোগ নির্ধারিত সময়ের চেয়ে এগিয়ে, ৭টি অন ট্র্যাকে এবং ৫টি কিছুটা পিছিয়ে আছে। ফেসবুক পোস্টে তিনি জানান,অগ্রগামী কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে— ওয়ান স্টপ সার্ভিস সংস্কার, স্টার্টার প্যাক চালু, সেমিকন্ডাক্টর টাস্কফোর্স গঠন ও এফডিআই হিটম্যাপ প্রকাশ। পিছিয়ে থাকা উদ্যোগগুলোর মধ্যে আছে— ট্যাক্স রুলস সংস্কার ও প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইসরি কাউন্সিল গঠন।

আশিক চৌধুরী বলেন, “শুধু প্রেজেন্টেশন নয়, বাস্তব অগ্রগতিও হয়েছে।” ফেসবুকে প্রকাশ করা তার লেখা হুবহু তুলে ধরা হলো:

আমাদের আমলনামা

ঠিক আট মাস হলো বিডা-বেজায় আজকে শুক্রবার (৬ জুন)। সরকারের বয়স প্রায় ১০ মাস। ব্যারিস্টার ফুয়াদ ঠিকই বলেছেন। একটা আমলনামা দেওয়া দরকার। আমরা কি শুধু দুইটা প্রেজেন্টেশন করলাম এতদিন ধরে? কিছু সাংবাদিক, ফেসবুক বিশেষজ্ঞ ও বটদের লেখা পড়লে তাই মনে হয়।  আমাদের রিপোর্ট কার্ডটি শেয়ার করলাম। ধৈর্য ধরে পড়ার অনুরোধ রইলো।

‘আমাদের কাজ মূলত তিনটা এরিয়ায়— ক. বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে পলিসি ও এক্সিকিউশনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া। খ. যারা দেশে অলরেডি বিনিয়োগ করেছেন, তাদের কেস বাই কেস ইস্যু সমাধানের মাধ্যমে এম্বাসেডর তৈরি করা। গ. দেশের ইমেজ ইমপ্রুভ করার পাশাপাশি একটা সলিড ইনভেস্টমেন্ট পাইপলাইন গঠন করা।

ক. একদম শুরুর দিকে দুইশ’রও বেশি দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তা ও সিইওদের পরামর্শ অনুযায়ী ৩০টি পদক্ষেপ শনাক্ত করা হয়। তার মধ্যে মোট ১৮টি নির্দিষ্ট সময়সীমার তুলনায় এগিয়ে আছে, ৭টিতে আমরা অন ট্র্যাক আছি, ৫টিতে আমরা প্ল্যানের থেকে পিছিয়ে আছি। এই প্রোগ্রেস আমরা প্রতি দুই মাস পরপর তাদের সঙ্গে ‘স্টেট অব ইনভেস্টমেন্ট ক্লাইমেট’ নামে ওয়েবিনার হোস্ট করে শেয়ার করি। ওয়েবিনারের লিংকগুলা কমেন্টে আছে। ডিসেম্বর-নাগাদ সবগুলা কমপ্লিট করার টার্গেট।

যেগুলোতে রোডম্যাপ/অরিজিনাল টাইমলাইন থেকে এগিয়ে আছি (প্রায়োরিটি অর্ডারে নয়):

১. ইনভেস্টর্স কনসালটেশন: ব্যবসায়ে প্রতিবন্ধকতা এবং তার সমাধান সম্মন্ধে তাদের সঙ্গে ডিটেল আলোচনা।

২. ১০০টি ইকোনমিক জোনের বদলে ৫টিতে ফোকাস করা। সেই পাঁচটিতে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, অন্যান্য ইনফ্রাস্ট্রাকচারের একটা রোডম্যাপ পাবলিশ করা। অব্যাবহৃত জমিতে সোলার পার্ক করা। সামরিক শিল্পে সক্ষমতার জন্য একটি মিলিটারি/ডিফেন্স ইকোনমিক জোন চালু করা।

৩. প্রতি মাসে আন্তঃমন্ত্রণালয় কোঅর্ডিনেশন মিটিং চালু করা; ব্যবসা পরিস্থিতি আলোচনা ও সমস্যা সমাধান করতে।

৪. গুরুত্বপূর্ণ বিনোয়োগকারীদের সমস্যা সমাধান করতে আলাদা একটি টিম গঠন করা।

৫. বিডার ওয়ান স্টপ সার্ভিস পোর্টালের মাধ্যমে পাওয়া সেবার পারফরমেন্স ডেটা (কতগুলো সেবা দেওয়া হলো, কার কতদিন লাগলো) বিডার ওয়েবসাইট এ পাবলিক করা।

৬. এফ ডি আই হিটম্যাপ: বাংলাদেশে কোন সেক্টরে বিনোয়োগ করা উচিত, কোন সেক্টরে সামনে সরকার পলিসি সাপোর্ট দেবে— এরকম একটা রিসার্চ প্রকাশ করা। এর সিকুয়েল হিসেবে একটি সেমিকন্ডাক্টর টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়েছে। আগামী মাসে তারা রিপোর্ট জমা দিবে।

৭. ফরেন কারেন্সি লোন গ্রহণ প্রক্রিয়ার উন্নতি— স্পিড টু  মার্কেট, ফ্লেক্সিবিলিটি, ইত্যাদি।

৮. এনবিআরে গ্রিন চ্যানেল বা অথোরাইজড ইকোনমিক অপারেটর চালু করা।

৯. এনবিআরে ডিজিটাল ইনভয়েসিং বা ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো চালু করা।

১০. বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরগুলোর এফিসিয়েন্সি বাড়ানোর জন্য পোর্ট স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণ। এর ধারাবাহিকতায় একটি ফ্রি ট্রেড জোন স্থাপন। 

১১. স্টার্টার প্যাক: ব্যবসা শুরু করার জন্য বেসিক যে কয়টি অনুমোদন লাগে, তা একটা ডিজিটাল ফর্মে নিয়ে আসা।

১২. বিডাতে একটি দক্ষ রিসার্চ উইং চালু করা

১৩. এফডিআই প্রোমোশনে সবার জন্য প্রণোদনা বা ইন্সেন্টিভ প্রোগ্রাম চালু করা।

১৪. ঢাকায় একটি ম্যাচমেকিং ইনভেস্টমেন্ট সামিট আয়োজন করা।

১৫. ইনস্টিটিউশনাল এক্সেলেন্স: বিডা-বেজাকে ডি নথিতে এনে সম্পূর্ণ পেপারলেস করা। বিডা অফিসে বিডা-বেজায় ডে কেয়ার চালু করা কর্মচারীদের জন্য।  বিনোয়োগকারীদের এবং কর্মচারীদের জন্য ক্যান্টিন, মিটিং ফেসিলিটি চালু করা।

১৬. কমিউনিকেশন স্ট্রাটেজি বা যোগাযোগ কৌশলের উন্নতি: পরিমার্জিত নতুন ওয়েবসাইট, যেটা এই মাসের শেষে লঞ্চ হবে, বিডা ও বেজার সোশ্যাল মিডিয়া প্রেজেন্স (লিংকডইন, এক্স, ফেসবুক, ইত্যাদি), লোগো রিভ্যাম্প, স্টার্টার এফএকিউ ইত্যাদি।

১৭. এনবিআর, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি বিডা অফিসে কোলোকেট বা সংস্থাপন করা। প্রত্যেক সরকারি অফিসের ব্যবসায়ীদের জন্য একজন ফোকাল পয়েন্ট পারসনের নাম পাবলিশ করা।

১৮. ওয়ার্ক পারমিট/ভিসা ও সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স ব্যবস্থার উন্নতি।

অন ট্র্যাক:

১৯. বিডায় গুরুত্বপূর্ণ ইনভেস্টরদের জন্য রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট টিম চালু করা। একইসঙ্গে দুই বছরের একটি প্রোগ্রাম ডিসাইন করে প্রাইভেট সেক্টরের দক্ষ অফিসারদের দেশের জন্য কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া।

২০. সরকারের সবগুলো ব্যবসায়ী সেবার জন্য করা ওয়ান স্টপ সার্ভিস ও ডিজিটাল প্লাটফর্মকে একীভূত করা বা একটি সিঙ্গেল সাইন ইন প্লাটফর্ম এ নিয়ে আসা।

২১. বিভিন্ন লাইসেন্সিংয়ের প্রয়োজনীয়তা চ্যালেঞ্জ করে লাইসেন্সের সংখ্যা কমিয়ে আনা।

২২. সরকারি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রাইভেটাইজ করা।

২৩. মার্জার ও একুইজিশন রুল সংস্কার।

২৪. বিডা-বেজার আইন আধুনিকীকরণ।

২৫. বিডা, বেজা, বেপজা, হাই টেক পার্ক ও পিপিপি অথরিটিতে সমন্বয়হীনতা কমাতে তাদের একই ছাতার নিচে নিয়ে আসা।

পিছিয়ে আছি:

২৬. প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইসরি কাউন্সিল চালু করা: সরকারকে একদম আনফিল্টার্ড ফিডব্যাক দেবার জন্য।  

২৭. ট্যাক্স রুলস: ইনকিউবেশন, গ্রান্ডফাদারিং, সানসেট রুলস।

২৮. ক্যাপিটাল রিপেট্রিয়েশন নীতি ওর প্রক্রিয়া সংস্কার।

২৯. বিডার সাংগঠনিক কাঠামো সংস্কার/আধুনিকায়ন।

৩০. এনার্জি সিকিউরিটি বা জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ স্ট্র্যাটেজি।

অনেকগুলো উদ্যোগ আমরা ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ইউএনডিপি, বিভিন্ন এম্বেসী আর প্রাইভেট সেক্টর পার্টনারদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে করছি। অনেকেই বিনা পারিশ্রমিকে দেশসেবা/সাহায্য করছেন। তাদের ছাড়া কিছুতেই সম্ভব হতো না আগানো। সংস্কারের কাজ আদৌ হচ্ছে কিনা, তাদেরকেও জিজ্ঞেস করতে পারেন।

খ. দেশের এক্সিস্টিং বিনিয়োগকারীদের সমস্যাগুলো সমাধান করার চেষ্টা করা এবং তাদের হয়ে পলিসি অ্যাডভোকেসি করা জরুরি। নতুনরা এসে তাদের কাছেই জানতে চাইবেন এদেশে ব্যবসা করা উচিত কিনা।

বেশ কিছু কোম্পানির ইস্যু সমাধান করা হয়েছে। যেমন- ইয়ংওয়ান গ্রুপ, মেটলাইফ, শেভরন, লাফার্জ, বাংলাদেশ অটোমোবাইলস। তারা পাবলিকলি এগুলা শেয়ার করেছেন। আরও অনেকে বাকি আছেন। তারা ডিসার্ভ করেন। কিন্তু লোকসল্পতার কারণে সবাইকে সাহায্য করতে পারছি না।

পলিসি অ্যাডভোকেসির ক্ষেত্রেও কাজ হচ্ছে। যেমন- ফুল ও পার্শিয়াল বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্স পলিসি সংস্কার, ম্যান মেড ফাইবার আনুষাঙ্গিক ইম্পোর্ট ডিউটি হ্রাস, ইন্সেটিভের জন্য নো ডেডাক্শন সার্টিফিকেট ইস্যু প্রক্রিয়া বদল, ইত্যাদি। কিছু রিফ্লেকশন এই বাজেট এ  এসেছে। আরো অনেক কিছু বাকি রয়ে গেছে। লম্বা লিস্ট। সামনে আশা করি আরও দেখতে পাবেন।

গ. আমরা আগে কখনও ইনভেস্টর পাইপলাইন ট্র্যাক করতাম না। ইনভেস্টর আমাদের দেশে এমনিতেই আসবে, এই আরোগ্যান্সের কোনও কারণ নাই। বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট মেন্যুর অনেকগুলা অপসনের মধ্যে একটা। তাছাড়া বিদেশে বসে গুগল সার্চ করলে আমাদের নিয়ে যে পারসেপশন তৈরি হয়, সেটা রিয়েলিটির চেয়ে অনেক বেশি নেগেটিভ। সামনের দিনগুলোতে এমন চাতক পাখির মতো যাতে বসে থাকতে না হয়, ইনভেস্টররা যাতে জানেন— কেন বাংলাদেশ ২.০ আগের চেয়ে আলাদা, দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীদের যাতে ম্যাচমেকিং হয়, সেজন্য আমরা দুটি সামিটের আয়োজন করেছি। একটি সবার জন্য, আরেকটি চীনকে ফোকাস করে। ৬৭৫ জন বিনিয়োগকারী এসেছেন এই প্রোগ্রামগুলোতে। দ্বিপাক্ষিক মিটিং হয়েছে বাংলাদেশি এবং বিদেশি উদ্যোক্তাদের মধ্যে তিনশোর একটু বেশি।

আমরা আগেও বলেছি, বিলিয়ন ডলার ইনভেস্টমেন্ট একদিনে আসে না। সামিটে এসে ইমোশনাল হয়ে কেউ হুট করে ১০০ কোটি টাকার চেক লিখে ফেলে না। যারা এই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজে করেন তারা জানেন। তারপরও সৌভাগ্যক্রমে তিনটি একদম নতুন বিনিয়োগ অলরেডি কনফার্ম করেছে। একটি গার্মেন্টস, একটি এয়ারলাইন্সের এমেনিটি কিট ও একটি ঘড়ি ম্যানুফ্যাকচারার। সব মিলিয়ে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। ১০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে ফ্যাক্টোরিগুলা চালু হলে। আরও প্রায় ১৫টি প্রজেক্ট আছে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ফাইনাল হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা— একটা সলিড পাইপলাইন তৈরি হলো। আগামীতে যারা বিডা চালাবেন, তাদের শূন্য থেকে শুরু করতে হবে না।

ইনভেস্টমেন্ট সামিট নিয়ে একটা হাইপ তৈরি হয়েছিল। সেটা আমাদের টার্গেট ছিল না। আমি আগেও অনেকবার বলেছি যে, আমরা খালি একটা গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড প্রোগ্রাম ডেলিভার করতে চেয়েছিলাম। এটার জন্য আলাদা কোনও বাহবা পাবার আশা আমরা একদম করি না। আরও ভালো করার অনেক সুযোগ আছে। কাজগুলো কমিটেড সময়ের মধ্যে হচ্ছে কিনা, এর জন্য আমাদের অ্যাকাউন্টেবল করুন। ধন্যবাদ। 

পুনশ্চ-১: অক্টোবর থেকে এপ্রিলের বিনিয়োগের পরিমাণ আর গত বছরের একই সময়ের নম্বরটা প্রায় একই। কিন্তু এতে বিডার কোনও ক্রেডিট বা ফেইলিও’র নাই। এত বড় অস্থিতিশীল পরিস্থিতির পরে এত তাড়াতাড়ি বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ আগের জায়গায় ফিরে গেছে তা আশার কথা।  কিন্ত এর পেছনে মূল শক্তি অর্থনৈতিক টার্ন অ্যারাউন্ড: রিসার্ভ বৃদ্ধি, এক্সচেঞ্জ রেট স্থিতি, ইত্যাদি।

পুনশ্চ-২: ইনফরমেশন প্লিজ ভেরিফায়েড সোর্স থেকে নেবেন। ভুল তথ্যের শিকার হবেন না। আমাদের জিজ্ঞেস করুন। আমরা উত্তর দেবার চেষ্টা করবো।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews