দেশ আজ ধ্বংসের পথে। বেকার সমস্যা, আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি, দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতি- ইত্যাদি নানান কারণে দেশ গভীর সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এই সব কিছু ঘটেছে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে ও তাদের কারণে। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া ব্যক্তিত্ব দেশের জুলাই গণআন্দোলনের সফল পরিস্থিতির পরে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অবস্থাদৃষ্টে বলা যায়, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দেশে চরম অনিশ্চয়তা ও অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।

বাংলাদেশের মানুষের এখন পৃথিবীর প্রায়ই দেশই ভিসা দিতে চাচ্ছে না। একইভাবে ওই দেশের জনগণকেও বাংলাদেশে ভ্রমণের বিষয়ে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে দেশি বা বিদেশি কোনও বিনিয়োগ হচ্ছে না, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্থবির। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বিদেশি বিনিয়োগের মঞ্জুরীকৃত অর্থ ফেরত নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ফলে পুরনো চাকরিজীবীরা চাকরি হারাচ্ছেন এবং যারা নতুনভাবে চাকরি খুঁজছেন তাদেরও চাকরির কোনও সুযোগ নেই। আর তাই বেকার সমস্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রতিদিন খারাপ থেকে খারাপ হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মনোবল হারিয়ে হতাশায় ভুগছে। তারা দিক নির্দেশনাহীন বলে মনে হচ্ছে। কোন দায়িত্ব পালন করলে ভালো হবে এবং কোনটা করলে মন্দ হবে সে সংশয়ে থাকে সারাক্ষণ।

বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিটি মানুষের আয় কমছে, ব্যয় বাড়ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও মূল্যস্ফীতি এখনও বিপদ সীমার ওপরে। দেশীয় উৎপাদিত পণ্য সমূহের বিশেষ করে কৃষি পণ্যের দাম উৎপাদনকারী বা কৃষকের হাতে পৌঁছে না। তাদেরকে অনেক কম দামে বিক্রয় করতে হয়। আবার একই পণ্য যখন শহরের বাজারে আসে তখন ভোক্তাদের অতি উচ্চ মূল্যে ক্রয় করতে হয়। সরকারি তরফ থেকে বলা হচ্ছে, ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজির কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। ফলে অভুক্ত ও অর্ধভুক্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।

সামনে এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে দেশে দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থা হতে পারে বলে আমি আশংকা করছি।

২০২৪ এর ১ জুলাই, ছাত্রদের চাকরির কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলন শুরু হয়। ৩ জুলাই, ২০২৪ তারিখে আমি জাতীয় সংসদে এ আন্দোলনকে সমর্থন করে বলেছিলাম, “এটা শুধু ছাত্রদের কোটা সংস্কার নয়, এটা সার্বিকভাবে বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম।”

ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন, ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। দলমত নির্বিশেষে দেশের প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। জাতীয় পার্টি সার্বিকভাবে এ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিল। দেশের সর্বত্র জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা আন্দোলনের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে গেছে।

অবশেষে ৫ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে এ আন্দোলনের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। সরকার প্রধান, হঠাৎ করে আন্দোলনকারী ছাত্র নেতাদের, তার সরকারের নিয়োগ দাতা ও অভিভাবক হিসেবে ঘোষণা করেন। তাদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে তার মন্ত্রিসভার সদস্য করেন। বাকি আন্দোলনের সমন্বয়ক বা তাদের সঙ্গীদের অন্যান্য সকল মন্ত্রণালয়ে ও সরকারি কার্যক্রমে সক্রিয় ভূমিকা রাখার কর্তৃত্ব দান করেন। ফলে, ছাত্র আন্দোলনকারীদের একটি অংশ দেশ পরিচালনায় সরকারের অভিভাবকের ন্যায় সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হন। সরকার প্রধান আন্দোলনটিকে ‘মেটিকুল্যাসলি ডিজাইনড’ অর্থাৎ সুপরিকল্পিত বলে অভিহিত করেন।

জাতীয় পার্টি ৫ আগস্টের পরে অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে যাচ্ছিল। ৭ অক্টোবর, ২০২৪ তারিখে ছাত্র সমন্বয়কদের দু’জন হঠাৎ করে জাতীয় পার্টিকে বিগত সরকারের দোসর বলে আখ্যা দেন ও বলেন তাদের রাজনীতি করার অধিকার নেই। এই বলে তারা তাদের ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। তারা হলেন, সার্জিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহ।

রংপুরের জাতীয় পার্টি ও সাধারণ জনগণ এই ঘোষণা ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেন এবং তাদেরকে রংপুরে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। পরবর্তীতে ছাত্র আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ নামে পরিচয় করিয়ে দেওয়া একজন উপদেষ্টা বা মন্ত্রী পদ মর্যাদার (মাহফুজ আলম) উনি সরকারিভাবে, আমাদের দোসর আখ্যা দিয়ে সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে আমাদের বাদ দেন। তখন থেকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে আমাদের সভা-সমাবেশ, মিছিল বা কোনোরকম রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে দেওয়া হচ্ছে না। নানানভাবে বাধাগ্রস্থ করা হচ্ছে।

ইতিমধ্যে ছাত্র সমন্বয়করা ও আন্দোলনে অংশ গ্রহণকারীদের কেউ কেউ নিজেরাই মুখ খুলতে শুরু করলেন। তাদের বক্তব্যে জানা গেলো, ছাত্রদের এ আন্দোলন অহিংস আন্দোলন ছিল না।

তাছাড়া ২১ মার্চ, ২০২৫ তারিখে তাদের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা, আসিফ মাহমুদ সজিব ভূইয়া ঢাকা টাইমস টু ডে-তে একটি সাক্ষাৎকারে বলেন যে, “৫ তারিখ যদি আমরা সফল না হতাম তাহলে আমরা অস্ত্র তুলে নেয়ার ঘোষণা দিতাম এবং নাহিদ ভাই ভিডিও বার্তাও রেডি রেখেছিল। আমিও কি ঘোষণা দিব সেটাও রেডি ছিল।” (ভিডিও ফুটেজ আছে) এই সংবাদটি ২১-০৩-২০২৫ তারিখ দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়। বিষয়টি আরো গভীরে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন মনে করি।

সমগ্র আন্দোলনটির সফলতার একক কৃতিত্বের দাবিদার হিসেবে তারা এ কথাগুলো প্রকাশ করেছিলেন।

একক দাবিদার! এজন্য দরকার ছিল যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে দেশের সকল স্তরের প্রায় সকল মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য। নির্বাচনের মাধ্যমে একটি জবাবদিহিতামূলক সরকার গঠন ও তার মাধ্যমে ভবিষ্যতে একটি বৈষম্যহীন সমাজ গঠন, এর জন্য তারা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলো।

আন্দোলনে সমন্বয়কদের দাবি হলো শুধু সুষ্ঠু নির্বাচন নয়, তারা আন্দোলন করেছে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের একটি রাষ্ট্র কাঠামো গঠনের জন্য। সে কাঠামোর রুপরেখা তারা যেটা বর্ণনা করলেন তাতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির একটা ছায়া দেখা গেলো।

সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে প্রতিবেশী দেশের ষড়যন্ত্র, মুক্তিযোদ্ধারা বিশ্বাসঘাতক, স্বাধীন বাংলাদেশে জন্ম ভুল, এ ধরনের মতবাদ ফুটে উঠেছে, মনে হলো।

এখন এটাও সুস্পষ্ট হলো, জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবির এ আন্দোলনে সর্বাত্মকভাবে সম্পৃক্ত ছিল। তারা ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনীতে ছিল, সমন্বয়কদের মধ্যেও ছিল, আন্দোলনের পদাতিক বাহিনী হিসেবে কার্যকর ভূমিকাও পালন করে গেছে।

সমন্বয়কদের অনেকের অতীত যতটুকু জানা গেছে, তাদের কেউ কেউ জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিকে ধারণ করে।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েব-এ-আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বিবিসি বাংলায় এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “… আমরা মৌলিক ভূমিকা পালন করেছি এবং খুবই সচেতন ছিলাম, এটা যে জামায়াত-শিবিরের একটা আন্দোলন সেটা যেন প্রকাশিত না হয়। আমরা চেয়েছি একটা সার্বজনীন দেয়ার জন্য। …”

১২ মে, ২০২৫ তারিখে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হলো, আইনের সংশোধনী এনে প্রশাসনিক আদেশে।

এখন জামায়াতে ইসলামী সহ কয়েকটি দল জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলকে নিষিদ্ধ করার পায়তারা করছেন।

পূর্বের সরকারের আদলে দেশের সিংহ ভাগ মানুষকে বাদ দিয়ে সরকারি দল ও আধা সরকারি দলের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা অগ্রসরমান।

ফলে, এ সরকারের অধীনে আগামী ফেব্রুয়ারিতে যে নির্বাচন হওয়ার কথা সেটা হলে নির্বাচনের আগে থেকে নির্বাচনের পরেও দেশ অস্থিতিশীল থাকতে পারে।

দেশ ধ্বংসের পথে অগ্রসরমান। এ থেকে উত্তোরণের একমাত্র পথ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। একটি অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনই হতে পারে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রথম পদক্ষেপ। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার উল্টো পথে হাঁটছেন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার দেশকে একটি খাদের কিনারে নিয়ে এসেছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দেশকে ধাক্কা দিয়ে খাদে ফেলে দিয়েছেন। যত তাড়াতাড়ি পতন আটকানো যাবে ততই দেশ কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সে কারণে, আর সময় ক্ষেপন না করে, সরকার পরিবর্তন অত্যাবশ্যক মনে করি।

একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও তার অধীনে সকল দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনই একমাত্র সমাধান।

লেখক: চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews